দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় জিম্মিদশায় থাকার পর সোমালি জলদস্যুদের কাছ থেকে মুক্তি পেয়েছে কবির রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) মালিকানাধীন বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ এবং এর ২৩ নাবিক। দস্যুরা মুক্তিপণের অর্থ পাওয়ার পর গত শনিবার নাবিকরা মুক্তি পান। জলদস্যুদের কত টাকা মুক্তিপণ দিতে হয়েছে— এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি জাহাজটির মালিক ও বাংলাদেশ সরকারের কেউ।
তবে সোমালি সংবাদমাধ্যম দ্য ডেইলি সোমালিয়া ও ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, যেসব জলদস্যু বাংলাদেশি জাহাজটি জব্দ করেছিল, তাদের মুক্তিপণ হিসেবে ৫০ লাখ ডলার দেয়া হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫৫ কোটি টাকার মতো। জাহাজ মালিক ও সরকার মুক্তিপণের বিষয়ে কোনো তথ্য গণমাধ্যমে না জানালেও সোমালি সংবাদমাধ্যম ও রয়টার্স মুক্তিপণের বিষয়টি নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদমাধ্যমগুলোর দাবি, তারা দুই দস্যুর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলেছে। দস্যুরা তাদের জানিয়েছে, দুদিন আগেই মুক্তিপণের অর্থ দেয়া হয়। এরপর অর্থগুলো আসল, নাকি নকল ছিল— সেটি যাচাই করা শুরু করে তারা। এরপর অর্থগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে তারা পালিয়ে যায়।
জাহাজটি দস্যুদের থেকে মুক্ত হওয়ার পর রোববার মালিকপক্ষ কেএসআরএমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম গণমাধ্যমে বলেন, জলদস্যু ও জাহাজের মালিক সংস্থার প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। কত টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে জলদস্যুরা জাহাজটিকে ছেড়েছে এবং কীভাবে মুক্তিপণ দেয়া হয়েছে— এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কোনো উত্তর দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মুক্তিপণের বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। আইনি উপায়েই সবকিছু করা হয়েছে। শিপিং-সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সব আইন মেনে আমাদের সমঝোতায় যেতে হয়েছে। এর মধ্যে ব্রিটিশ, মার্কিন, কেনিয়ান ও সোমালিয়ান আইনি ধারাও মানতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সফল আলোচনা ও সমঝোতা শেষে দস্যুরা আমাদের জাহাজ থেকে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শনিবার রাত ৩টার দিকে আমার কাছে জাহাজের ক্যাপ্টেনের পক্ষ থেকে প্রথম মেসেজ আসে। তখন দস্যুরা মোট ৬৫ জন ছিল। তারা মোট ৯টি বোটে করে জাহাজ থেকে নেমে চলে যায়। এরপর জাহাজের স্পিকারে ঘোষণা দেয়া হয়। তখন জাহাজের ভেতরে কান্নার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে সমঝোতা চুক্তির সবকিছু প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’ জাহাজে নিরাপত্তা গার্ড না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, একটি কথা বারবার আসছে, কেন আমরা আর্মড গার্ড নিইনি। এর কারণ হচ্ছে আমরা অতিঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাইরে ছিলাম। সাধারণত ২০০ নটিক্যাল মাইলের ভেতর অতিঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসাব করা হয়। কিন্তু আমরা যাচ্ছিলাম মোটামুটি ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূর দিয়ে। গত ৮-৯ বছরে ওই এলাকায় এরকম কোনো ঘটনা ঘটেনি, যেখানে আর্মড গার্ড নিতে হয়। এ কারণে আমরা আর্মড গার্ড নিইনি। মুক্তি পাওয়ার পরপর বেশ কজন নাবিক তাদের পরিবারকে জানান, একটি ছোট উড়োজাহাজ থেকে মুক্তিপণের টাকাভর্তি তিনটি ব্যাগ জাহাজের কাছে সমুদ্রে ফেলা হয়। পরে স্পিডবোটে থাকা জলদস্যুদের একটি দল ব্যাগগুলো সংগ্রহ করার পর মুক্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এমন একটি ভিডিওচিত্রও প্রকাশ করা হয়।
এদিকে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ ও জিম্মি ২৩ নাবিকের মুক্তিতে মুক্তিপণ দেয়ার ভিডিওচিত্র দেখা যাওয়া প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সন্দেহ পোষণ করে বলেছেন, এটা কোনো সিনেমার ছবিও (দৃশ্য) হতে পারে। উড়োজাহাজ থেকে ফেলে ব্যাগে করে মুক্তিপণ দেয়ার ভিডিও দেখা গেছে, এ বিষয়ে কী বলবেন? এ প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এটা এখন কোন সিনেমার ছবি আমি তো জানি না। ?এমন ছবি তো আমরা অনেক চলচ্চিত্রেও দেখি। কোন ছবি কোথায় গিয়ে কীভাবে যুক্ত হয়েছে, কোনটার সঙ্গে কোনটা এডিট হয়েছে আমি জানি না।’ তিনি বলেন, ‘জানতাম পরিত্যক্ত জিনিস পানিতে ফেলে। এত দামি জিনিস (ডলার) পানিতে ফেলে জানা ছিল না!’ জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া জাহাজটি এখন দুবাইয়ের উদ্দেশে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সেটি ১৯ বা ২০ এপ্রিল গিয়ে পৌঁছাবে। এর পরের পুরো বিষয়টি জাহাজ ও নাবিকদের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়। নাবিকরা কতদিনের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে গেছেন, সেই চুক্তি তারা বহাল রাখবেন, নাকি তারা ফিরে আসবেন। তিনি আরও বলেন, জাহাজ মালিক জানিয়েছেন, তারা (নাবিকরা) যদি চান বাংলাদেশে ফিরে আসবেন, তাহলে তাদের বিমানযোগে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হবে। প্রসঙ্গত, গত ১২ মার্চ মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে কয়লা নিয়ে যাওয়ার পথে ভারত মহাসাগরে সোমালি দস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ।