দেশজুড়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন কার্যক্রম চলছে। আর মাত্র এক দিন পরই ৮ মে চার ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। চলতি মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহণ শেষে পরবর্তী মাসের প্রথম সপ্তাহে চতুর্থ এবং শেষ ধাপের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। স্থানীয় সরকারের এই বৃহৎ নির্বাচন নিয়ে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন, প্রার্থীর ভালো দিকগুলো তুলে ধরে ভোট প্রার্থনা ও দোয়া চাচ্ছেন। এক কথায় বিরামহীন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকরা।
এদিকে চলমান এ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি। কারণ, নির্বাচন নিয়ে এ দুটি দলের নেয়া অবস্থানে পাত্তা দিচ্ছেন না দল দুটির তৃণমূল নেতারা।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু ভোট হবে না— এমনটি দাবি করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও অন্যতম বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের মিত্র অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল। চলমান উপজেলা নির্বাচনের ক্ষেত্রেও একই নীতি অবলম্বন করছে বিরোধীরা। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না বলে ঘোষণা দেয়। ঘোষণা অনুযায়ী দলগুলো নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ রাখে; কেউ নির্বাচনে গেলে কঠোর অবস্থান নেয়ার কথাও জানানো হয় দলগুলোর পক্ষ থেকে। কিন্তু কেন্দ্রের এসব অবস্থানকে আমলেই নেননি তৃণমূল বিএনপি নেতারা। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপি নেতারা ভোটের মাঠে রয়েছেন। যারা নির্বাচনে রয়েছেন, তাদের শনাক্ত করে দলীয় পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানানো হয় শতাধিক তৃণমূল নেতাকে।
কিন্তু বহিষ্কারাদেশকেও আমলে নিচ্ছেন না ওইসব নেতা। তারা মনে করছেন, নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে জনপ্রিয়তার কারণে তারা সাধারণ ভোটারদের সমর্থন নিয়ে বিজয়ী হবেন; আর বিজয়ী হলে দল বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে কাছে টেনে নেবে। দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে বিএনপির এসব নেতা ভোটে থেকে যাওয়ায় দলীয় চেইন অব কমান্ডের মজবুতি নিয়ে টেনশনে পড়েছেন নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করছেন, সিদ্ধান্ত অমান্যকারীদের বিষয়ে শূন্য সহনশীলতায় থাকার বিকল্প নেই। বিএনপির পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা রয়েছে— এমন প্রার্থীরাও ভোটে রয়েছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। তবে দলটির দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউ ভোটে নেই বলে জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলও তৃণমূল নেতা এবং মন্ত্রী-এমপিদের নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার দলের মন্ত্রী ও এমপিদের স্বজনদের কেউ ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। মন্ত্রী-এমপিদের স্ত্রী-সন্তান বা নিকটাত্মীয়রা যাতে ভোটে না থাকেন, এজন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও এমপিদের ফোন করে দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। এছাড়া সংবাদ সম্মেলন করে বারবার এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু এতে কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা ভোট থেকে সরেননি। তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত রাখছেন। দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরও কেন সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি, তা নিয়ে বিভিন্ন সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে।
গতকাল অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনেও এ বিষয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হন ওবায়দুল কাদের। বিশ্লেষকরা বলছেন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে দল থেকে বারবার নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। গতকাল আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক বিফ্রিংয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরত রাখা আওয়ামী লীগের নীতিগত সিদ্ধান্ত; এখানে আইনগত কোনো বিষয় নেই। দীর্ঘ সময় ধরে প্রচেষ্টা চালিয়েও দলটি নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে না পারায় অনেকটা অস্বস্তিতে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদ চালু হওয়ার পর ১৯৯০ ও ২০০৯ সালে একদিনেই ভোট হয়েছিল। ২০১৪ সালে চতুর্থ উপজেলা নির্বাচন ছয় ধাপে ও ২০১৯ সালে পাঁচ ধাপে পঞ্চম উপজেলা পরিষদের ভোট হয়। প্রথম চারটি উপজেলা নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হলেও আইন সংশোধন হওয়ায় ২০১৭ সালের মার্চে মেয়াদোত্তীর্ণ তিনটি উপজেলায় দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়েছিল। পরে ২০১৯ সালে দলীয় প্রতীকে পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন হয়। এবার মাঠে অন্য কোনো দল না থাকায় প্রতীক ছাড়া ভোট করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী প্রথম দফায় ভোটগ্রহণ হবে ৮ মে। দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে, তৃতীয় ধাপে ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপে ভোটগ্রহণ হবে ৫ জুন। চতুর্থ, অর্থাৎ শেষ ধাপে ৫৫টি, তৃতীয় ধাপে ১১২টি, দ্বিতীয় ধাপে ১৬১টি এবং প্রথম ধাপে দেশের ১৫২ উপজেলা পরিষদে ভোট অনুষ্ঠিত হবে।