এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স

আর্থিক কেলেঙ্কারির পরও সিইও শাহ জামাল

মো. ইমরান খান প্রকাশিত: মে ১২, ২০২৪, ১১:৫৩ এএম

অর্থ আত্মসাতের বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ থাকার পরও দণ্ডিত হননি এনআরবি ইসলামিক লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ জামাল হাওলাদার। উল্টো পুরস্কৃত হয়েছেন। পেয়েছেন পদোন্নতি। উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে হয়েছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর পূর্বে একটি কোম্পানি তাকে বহিষ্কার করেছে। এ তথ্য জেনেও শাহ জামাল হাওলাদারকে এনআরবি ইসলামিক লাইফের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার পদে দফায় দফায় নিয়োগ অনুমোদন দিচ্ছে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। কেন এমনটি করা হচ্ছে সে সম্পর্কেও কিছু বলতে চাচ্ছে না এই নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। 

খবর নিয়ে জানা গেছে, কর্মজীবনে অন্তত ছয়টি বিমা কোম্পানিতে চাকরি করেছেন শাহ জামাল হাওলাদার। তবে একটি প্রতিষ্ঠানও তাকে ছাড়পত্র দেয়নি। ছাড়পত্র ছাড়াই তিনি এক কোম্পানি থেকে অপর কোম্পানিতে নিয়োগ নিয়েছেন। শাহ জামাল হাওলাদার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে সর্বশেষ চাকরি করেছেন বেস্ট লাইফে। এর আগে চাকরি করেছেন প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফে, সিনিয়র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে। দুটি কোম্পানির একটিও তাকে ছাড়পত্র দেয়নি। তার বিরুদ্ধে ওঠা অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন ও সাময়িক অব্যাহতির নোটিস দেয়ার পর প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ থেকে পদত্যাগ করেন শাহ জামাল। প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সের ১৩ লাখ টাকা প্রিমিয়াম আত্মসাতের অভিযোগে ২০২০ সালের ১৭ জুন তাকে বহিষ্কার করা হয়। ওইদিনই তিনি কোম্পানি থেকে পদত্যাগের জন্য পত্র জমা দেন। তবে পদত্যাগ কার্যকরের আবেদন করেন ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ থেকে।

প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফ থেকে শাহ জামালের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়। এর মধ্যে রয়েছে— নরসিংদী অফিস থেকে আট লাখ ৬০ হাজার ৩৭৪ টাকা হিসাবের গরমিল, দুজন ড্রাইভার নিয়োগ দেখিয়ে বেতন-ভাতা উত্তোলন করলেও বাস্তবে কোনো ড্রাইভারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি, ক্যাশিয়ারের বেতন বাবদ টাকা উত্তোলন করা হলেও কোনো ক্যাশিয়ার নিয়োগ দেয়া হয়নি, ভোলা ব্রাঞ্চের গ্রাহকদের কাছ থেকে নেয়া প্রিমিয়ামের ১৩ লাখ টাকা কোম্পানির অ্যাকাউন্টে জমা দেয়া হয়নি, মতিঝিল শাখায় ২৭ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে পিআর কেটে কোম্পানির অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করা হয় পরের বছরের জুন মাসে, যা বিমা আইনের লঙ্ঘন। 

শাহ জামালের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অর্থ আত্মসাতের এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে কারণ দর্শানো ও দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহিত প্রদানের নোটিসে স্বাক্ষর করেন প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফের তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইউসুফ আলী মৃধা।

পেইড আপ ক্যাপিটালের চেয়ে বিনিয়োগ কম, খরচ হয়েছে গ্রাহকের সব টাকা। আইডিআরএর মূলধন-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এনআরবি ইসলামিক লাইফ অনুমোদন পায় ২০২১ সালের ৬ মে। অনুমোদনের পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছরে সর্বমোট প্রিমিয়াম আয় করে ৭৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় করে ৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এই হিসাবে ব্যবসার আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে কোম্পানিটিতে উদ্বৃত্ত টাকা থাকে ১৭ কোটি আট লাখ টাকা। হিসাব  অনুসারে এই উদ্বৃত্ত ১৭ কোটি আট লাখ টাকা বিনিয়োগ থাকার কথা। অথচ আইডিআরএর মূলধন-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে ৩১ ডিসেম্বরে ২০২৩ সাল পর্যন্ত  কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয় থেকে বিনিয়োগ রয়েছে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর মোট বিনিয়োগ রয়েছে ১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। যার মধ্যে মূলধন থেকে বিনিয়োগ আছে ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ আছে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা। অপরদিকে কোম্পানির পেইড-আপ ক্যাপিটাল ১৮ কোটি টাকা। এই  হিসাবে পেইড-আপ ক্যাপিটালের চেয়ে বিনিয়োগ কম আছে দুই কোটি ৮৯ লাখ টাকা।অর্থাৎ গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়াম আয়ের প্রায় সব টাকাই খরচ করে ফেলেছে।

মূলধন সংক্রান্ত আইডিআরএর তদন্ত অনুসারে প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানি পরিচালনার জন্য মূলধন থেকে তোলা হয় চার কোটি টাকা। এই টাকা অদ্যাবধি জমা করেননি। অপরদিকে ২০২১ সালে বিদেশে অফিস স্থাপন ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য মূলধন থেকে তোলা হয় আরও তিন কোটি টাকা। এনআরবি ইসলামিক লাইফের মূলধন-সংক্রান্ত এই তদন্তটি করা হয় গত ডিসেম্বরে। আইডিআরএ দাখিল করা ব্যবসা-সংক্রান্ত প্রতিবেদনগুলোর তথ্য অনুসারে এনআরবি ইসলামিক লাইফ প্রতিষ্ঠার পর তিন বছরেই অতিরিক্ত ব্যয় ৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। তবে এমন দুর্বল আর্থিক অবস্থার মধ্যেও মুখ্য নির্বাহী নিয়োগ নবায়নে বেতন-ভাতা দিগুণ করেছে কোম্পানিটি। 

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে সম্প্রতি তার মোবাইল ফোনে কল করা হলে শাহ জামাল হাওলাদার দৈনিক আমার সংবাদকে জানান, তিনি নির্বাচনি কাজে ব্যস্ত আছেন, এ বিষয়ে তিনি এখনই কথা বলতে পারছেন না। আজ রোববার তিনি প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাতে কথা বলতে পারবেন বলে জানান। 

আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বিষয়টি অস্বীকার করে কোম্পানির চেয়ারম্যান কিবরিয়া গোলাম মোহাম্মদ আমার সংবাদকে বলেন, উনার বিষয়ে কোনো আর্থিক কেলেঙ্কারি আমরা পাইনি এবং এক টাকারও আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ তার ব্যাপারে নেই। 

তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু বিমা কোম্পানির পেইড সাংবাদিক আছে, তাদের মাধ্যমে আমাদের ব্যাপারে অনেক মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি নন। কোনো বিষয়ে জানতে হলে আইডিআরএর মূখপাত্র মো. জাহাঙ্গির আলমের কাছে জানতে বলেন তিনি। পরবর্তীতে এ বিষয়ে জানতে আইডিআরএর মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গির আলমকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।