সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই আমরা তাকে নিয়োগ দিয়েছি
—কিবরিয়া গোলাম মোহাম্মদ
চেয়ারম্যান, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স
আইডিআরএর সব শর্ত পূরণ করেই এমডি হয়েছি
—শাহ জামাল হাওলাদার, মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড
শাহ জামাল হাওলাদার। অনিয়মের বিস্তর তথ্য গোপন রেখে ২০২১ সালে এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ নেন। নিয়োগ পাওয়ার পরও তিনি ব্যস্ত ছিলেন অনিয়মে। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ লাভের জন্য যে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকা দরকার, তা তার ছিল না। তবে তিনি থেমে যাওয়ার লোক নন, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভুয়া সনদ জোগার করে স্বপদে টিকে রয়েছেন। কোনো কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের আবেদন এলে ওই আবেদনের সঙ্গে দেয়া সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র ঠিক আছে কি-না তা যাচাই করার দায়িত্ব বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ)। কিন্তু কর্তৃপক্ষ হয় তা যাচাই করে না, আর না হয় যাচাই করে ভুয়া কাগজপত্র ঠিকই পাচ্ছেন, কিন্তু শেষ বেলায় এসে নানা প্রক্রিয়ায় ম্যানেজ হয়ে যায়, ফলে ভুল বা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়ে যান।
খবর নিয়ে জানা গেছে, এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্সের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেতে অভিজ্ঞতার মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন শাহ জামাল হাওলাদার। পেশাজীবনে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত (সংলগ্ন বা পিঠাপিঠি) নিম্নপদে কোনো বিমা কোম্পানিতেই চাকরি করেননি, অথচ মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে চাকরির একাধিক সনদ দাখিল করেছেন তিনি। তার কর্মঅভিজ্ঞতা নেই মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে। আইডিআরএ দেয়া তথ্যানুসারে শাহ জামাল হাওলাদার সর্বশেষ বেস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্সের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ছিলেন। সেখানে তার দেয়া তথ্য মতে, ২০২০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ১৬ মার্চ পদত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত তিনি কোম্পানিটির এ পদে কাজ করেছেন। অথচ উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) বেস্ট লাইফের মুখ্য নির্বাহীর নিম্নপদ নয়। কোম্পানিটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ তথা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পরবর্তী নিম্নপদ ‘অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এডিশনাল এমডি)’ ।
জানা যায়, ২০১৩ সালে অনুমোদন লাভের পর থেকে বেস্ট লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ ছিল এবং ২০২১ সালের ১৬ মার্চ পদত্যাগের আগ পর্যন্ত কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ছিলেন মো. খোরশেদ আলম। শাহ জামাল হাওলাদার অভিজ্ঞতা হিসেবে আরও উল্লেখ করেন, এর আগে প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফের ঊর্ধ্বতন উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১৭ জুন পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। কোম্পানিটিতে তিনি যোগদান করেন ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে।
অথচ এই কোম্পানিটিতেও উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) কোম্পানিটির মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদ নয়, এটি তৃতীয় সর্বোচ্চ পদ। প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফেরও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ ‘অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এডিশনাল এমডি)’। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালে প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন কোম্পানিটির বর্তমান মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ডা. কিশোর বিশ্বাস। এর আগে কোম্পানিটির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে ছিলেন আলহাজ জাহাঙ্গীর আলম।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফে মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদে চাকরির অভিজ্ঞতার বিষয়ে দুটি সনদ দাখিল করেছেন শাহ জামাল হাওলাদার। সনদ দুটি ইস্যু করা হয়েছে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি এবং একই বছরের ১৬ জুন। দুটি সনদেই স্বাক্ষর রয়েছে কোম্পানিটির তৎকালীন মুখ্য নির্বাহী মো. ইউসুফ আলী মৃধার। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইস্যু করা চিঠিতে বলা হয়েছে, শাহ জামাল হাওলাদার ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর (উন্নয়ন প্রশাসন ও মার্কেটিং) পদে যোগদান করেন, যা কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত দ্বিতীয় পদ। এতে আরও বলা হয়, প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফে শাহ জামালের মোট কর্মঅভিজ্ঞতা ৫ বছর ৯ মাস এবং কোম্পানিতে তার ক্যারিয়ারের পুরো সময়টি মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত দ্বিতীয় পদে কর্মরত ছিলেন।
অপরদিকে ২০২০ সালের ১৬ জুন ইস্যু করা আরেক চিঠিতে বলা হয়, শাহ জামাল হাওলাদার সিনিয়র ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর (উন্নয়ন প্রশাসন ও মার্কেটিং) পদে ২০১৪ সালের ৩০ এপ্রিল প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফে যোগদান করেন, যা কোম্পানির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তথা মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত নিম্নপদ। প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার অব্যবহিত নিম্নপদ অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রোটেক্টিভ ইসলামী লাইফের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, কোম্পানির মুখ্য নির্বাহীর অব্যবহিত পরের পদ ‘অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক’।
অভিজ্ঞতার মিথ্যা তথ্যের বিষয়টি অস্বীকার করে শাহ জামাল হাওলাদার দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমি আইডিআরএর সব শর্তপূরণ করেই এমডি হয়েছি। আমার অভিজ্ঞতার সব সনদই আছে, এজন্য আইডিআরএ আমাকে নিয়োগ দিয়েছে।’
শাহ জামাল হাওলাদারের এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এনআরবি ইসলামিক লাইফের চেয়ারম্যান কিবরিয়া গোলাম মোহাম্মদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমরা সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই তাকে নিয়োগ দিয়েছি এবং আইডিআরএও সবকিছু যাচাই-বাছাই করে তাকে অনুমোদন দিয়েছে।’ তবে এমন জালিয়াতির বিষয় নিয়ে আপত্তি তুলেছেন বিমা সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, যাদের কাছে জনগণের শত শত কোটি টাকা আমানত থাকে, তাদের বিষয়ে যদি এমন জালিয়াতির প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আইডিআরএ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে এটা বিমা খাতের জন্য অশনি সংকেত।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে তিনি কথা বলতে রাজি নন। কোনো বিষয়ে জানতে হলে আইডিআরএর মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলমের কাছে জানতে বলেন তিনি। তবে এ বিষয়ে জানতে আইডিআরএর মুখপাত্র মো. জাহাঙ্গীর আলমকে বারবার ফোন করা হলেও কোনো সাড়া দেননি তিনি।