ইতিবাচক কার্যক্রমে পরিবেশ অধিদপ্তর

ইয়ামিনুল হাসান আলিফ প্রকাশিত: মে ১৯, ২০২৪, ১০:০৮ পিএম

সরকারের ইতিবাচক কার্যক্রম ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎপরতায় সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে কমে আসছে
—ড. শহীদুর রহমান খান, সাবেক উপাচার্য, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্ষমতা আরও বাড়ানো গেলে দূষণ অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব
—ড. রাশেদুজ্জামান পবিত্র, চেয়ারম্যান, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, বশেমুরবিপ্রবি

আমাদের লোকবল বৃদ্ধির কাজ চলছে, আশা করি দ্রুতই এর সমাধান হবে
—মো. ছিদ্দিকুর রহমান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-২০৩০ অর্জনে বর্তমান সরকার প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পরিবেশবাদী কার্যক্রমে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন ইউএই জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশমন্ত্রী ড. আমনা বিনতে আবদুল্লাহ আল দাহাক। বাংলাদেশে এসে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করেছিলেন তিনি। 

পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার রেখে গতকাল রোববার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাত দিনব্যাপী ১১তম জাতীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বলেন, আমাদের শিল্প খাতকে পরিবেশবান্ধব করতে চাই। শিল্প খাত পরিবেশবান্ধব হওয়া উচিত। 

শেখ হাসিনা আরও বলেন, যারা যেখানেই শিল্প গড়ে তুলবেন, সেখানে অবশ্যই লক্ষ রাখবেন শিল্পবর্জ্য যাতে নদীতে না পড়ে, আমাদের পানি যেন কোনোভাবেই দূষিত না হয়; সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার জন্য আমি বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি।
মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নিয়ে কর্মদিবসের প্রথম দিনই পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী প্রাথমিকভাবে ১০০ দিনের কর্মসূচি নিয়ে কাজ এগিয়ে নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন। এরপর থেকেই বাংলাদেশকে বৈশ্বিক পরিবেশগত শাসনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রাখতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্দেশনা দিয়ে সে অনুযায়ী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন তিনি। পরিবেশ অধিদপ্তরও সে অনুযায়ী দূষণমুক্ত পরিবেশ গড়তে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজের ভেতরে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। 

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আবদুল হামিদ বলেন, পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই এ কাজে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। 

এদিকে বৈশ্বিক সূচকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত নগরীগুলোর তালিকায় কয়েক বছর ধরেই শীর্ষ দিকে অবস্থান করছে রাজধানী ঢাকা। শুধু ঢাকাই নয়, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ রাজধানীর বাইরের শিল্পাঞ্চলগুলোতেও দূষণ ঘটছে সহনীয় মাত্রার চেয়েও অনেক বেশি। এসব দূষণের জন্য মানুষের অসচেতনতার পাশাপাশি শিল্প-কারখানা মালিকদের ‘আইনের থোড়াই কেয়ার’কে দুষছেন বিশিষ্টজনরা। এক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল ও ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি এবং আইনের প্রয়োগ অতিরিক্ত মাত্রার পরিবেশ দূষণ কমিয়ে আনতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। দেশের শিল্প-কারখানার রাসায়নিক বর্জ্যনিঃসৃত দূষিত পদার্থ ও দূষিত পানি-বাতাস মিশছে পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে। এতে কৃষিজমি, নদী, খাল-বিলসহ জলাশয়ের পানি-বাতাস দূষিত হওয়ায় হুমকিতে পড়ছে পরিবেশ। অতিমাত্রায় পরিবেশ দূষণ যখন উদ্বেগ বাড়াচ্ছে, পরিবেশবিদসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলে তখন পরিবেশ দূষণ রোধে ইতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে পরিবেশ অধিদপ্তর। 

পরিবেশ অধিদপ্তর দীর্ঘদিন ধরে দূষণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০)-এর বাস্তবায়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জীবনিরাপত্তা  নিশ্চিতকরণ ও পরিবেশ সুরক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং উন্নয়নকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সংবিধানে ১৮(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর নিরাপত্তা বিধান করবে। এছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ রক্ষায় সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে।  

পরিবেশ অধিদপ্তর দেশের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের দূষণ জরিপ করে দূষণকারী প্রতিষ্ঠান চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করছে। প্রয়োজনে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও বিধি লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা এবং পরিবেশ আদালতে মামলা দায়েরের মাধ্যমে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করায় পরিবেশ দূষণ থেকে সরে আসতে বাধ্য হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এছাড়া  পরিবেশ দূষণকারীদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের অঙ্ক বাড়িয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর।  ধার্যকৃত অর্থ আদায়ের ফলে এবং পরিমাণ বাড়ানোয় পরিবেশ দূষণ কমবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি নতুন স্থাপিতব্য বা বিদ্যমান শিল্প-কারখানার কিংবা প্রকল্পকে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে পরিদর্শনের পাশাপাশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সন্তোষজনক হলেই কেবল প্রদান করা হচ্ছে ছাড়পত্র। পাহাড়ি অঞ্চলে নির্বিচারে পাহাড় কর্তন রোধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আসছে পরিবেশ অধিদপ্তর। দেশের কৃষি খাতকে সমৃদ্ধ করতে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান সরকার কৃষি খাতকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে শুরু থেকেই। আর এই খাতের উন্নয়নে পরিবেশ দূষণ যেন অন্তরায় না থাকে, এজন্য বায়ু ও পানির গুণগত মান পরীক্ষা, বিশ্লেষণ ও রিপোর্ট প্রদান করে আসছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও বিশিষ্ট কৃষিবিদ অধ্যাপক ড. শহীদুর রহমান খান বলেন, ‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই কৃষি খাতকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে। পরিবেশ দূষণের ফলে মানব দেহের পাশাপাশি কৃষি খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো বিশ্বজুড়েই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়ছে। আর সেই প্রভাব গিয়ে পড়ছে কৃষিক্ষেত্রেও। তবে সরকারের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎপরতায় সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে কমে আসছে।’

ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে অবকাঠামো নির্মাণ, বাড়ছে যানবাহন ও কল-কারখানার সংখ্যা। এসব উৎস থেকে সৃষ্ট দূষণও এ জন্য বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে তাল মিলিয়ে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘমেয়াদি বায়ুর গুণগতমান পরিবীক্ষণ থেকে দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে বাতাসে গ্যাসীয় পদার্থ ও বস্তুকণা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকলেও শুস্ক মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ) রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের মানব স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পরিবেশের ওপর বায়ু, শব্দ ও পানিসহ বিভিন্ন দূষণ এবং অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব নিরসনে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটার প্রচলন, যানবাহন ও কল-কারখানাসৃষ্ট ক্ষতিকর ধোঁয়া  নিয়ন্ত্রণ, অবকাঠামো নির্মাণ কার্যক্রম থেকে দূষণ নিয়ন্ত্রণসহ নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সনাতন পদ্ধতির ইটভাটা বন্ধ করে আধুনিক ইটভাটা তৈরির জন্য উৎসাহিত করার পাশাপাশি তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার তৈরি করে নিয়মিত মনিটরিং করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ফলে পরিবেশ দূষণের পরিমাণও কমছে। তবে এতসব ইতিবাচক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেও পরিবেশ দূষণ সহনীয় মাত্রায় না আসার পেছনে বড় কারণ হলো জনসাধারণের মধ্যে অসচেতনতা, শিল্প-কারখানাগুলোর আইন অমান্য এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রয়োজনের তুলনায় অল্প জনবল নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা বলে মনে করছেন পরিবেশ ব্যবস্থাপনা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। 

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রাশেদুজ্জামান পবিত্র বলেন, ‘পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর অনেকটাই কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। বিভিন্ন সেমিনার, বিতর্ক অনুষ্ঠান ও জনসচেতনতামূলক কাজকর্ম করে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর। তবে আইনের প্রয়োগ বাড়ানো হলে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের ক্ষমতায়ন আরও বাড়ানো গেলে পরিবেশ দূষণ অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।’ তবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ও সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক, গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের নিয়ে ওয়ার্কশপ, সভা-সেমিনারসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। পাহাড় কর্তন, জলাধার ভরাটের বিরুদ্ধেও নেয়া হচ্ছে ব্যবস্থা। 

এছাড়া নিয়মিত শিল্প-কারখানা পরিদর্শন, পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি যে কোনো অভিযোগ নিয়ে প্রতিমাসেই গণশুনানির আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। 
পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ছিদ্দিকুর রহমান দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘আমাদের লোকবল বৃদ্ধির কাজ চলছে। আশা করি দ্রুতই লোকবল বাড়বে। এছাড়া আমরা রুটিন কার্যক্রম পরিচালনা করছি, অভিযান চালাচ্ছি। আগামী ৫ জুন পরিবেশ দিবস উপলক্ষেও সার্বিক সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’