সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে —আহসান এইচ মনসুর
সংকট কাটানোর চেষ্টা করছি —আইসিবি এমডি
ব্যাংকটির ৮৭ শতাংশ ঋণই খেলাপি
ইতালি প্রবাসী আফসার উদ্দিন। বাড়ি মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে। এফডিআরের টাকা তোলার জন্য ঘুরছেন আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মতিঝিল শাখায়। তিন দিন এসেছেন। কিন্তু এক দিনও ব্যাংক ম্যানেজারকে পাননি। টাকা চাইলে হেড অফিসে যোগাযোগ করতে বলেন। গতকাল রোববার দুপুরে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক মতিঝিল শাখার গেটের সামনে সাংবাদিকদের এমনটাই জানালেন আফসার উদ্দিন।
সাংবাদিকদের আফসার উদ্দিন বলেন, আমি ১৯৮৮ সালের পর থেকে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করছি। এর আগে আমি কুয়েতে থাকতাম, বর্তমানে ইতালিতে থাকি। আমি প্রথমে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকে পাঁচ লাখ ৮০ হাজার টাকা রেখেছিলাম। বর্তমানে আমার টাকা আছে সাত লাখ ২০ হাজার। আমি আজ নিয়ে তিনবার এলাম। তারা আমাকে দেব দেব বলে ঘোরাচ্ছে। তিন দিনের মধ্যে একদিনও এসে ম্যানেজারকে পাইনি। যখনই আসি, তখনই বলা হয় ম্যানেজার বাইরে চলে গেছেন। শুনেছি আইসিবির অন্যান্য শাখায়ও নাকি গ্রাহক টাকা তুলতে পারছেন না। তারা আমাকেও বলেছেন তাদের টাকার সংকট আছে। আর টাকার বেশি দরকার হলে হেড অফিসে যেতে বলেছেন।
আফসার উদ্দিনের অভিযোগের বিষয়ে জানতে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ভেতর প্রবেশ করতে গেলে সাংবাদিক বুঝতে পেরেই আটকে দেন এক নিরাপত্তাকর্মী। বলেন, ম্যানেজার স্যার নেই। কোনো বিষয়ে জানার থাকলে হেড অফিসে যান। এখানে জানার কিছু নেই।
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের দুরবস্থা নিয়ে কথা বললে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, এই ব্যাংকের বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এখানে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতে হবে। সেটা আর্থিকভাবে করুক আর আইনগতভাবেই করুক। অন্যথায় এর প্রভাব অন্য ব্যাংকগুলোতেও পড়বে। দ্রুত সমাধান না করলে ব্যাংক নিয়ে মানুষের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, খেলাপি বেড়ে যাওয়ায় কিছু সমস্যা পূর্ব থেকেই চলে আসছে। আর গত ডিসেম্বরে ব্যাংক একীভূতকরণের আলোচনা শুরুর পর থেকেই মূলত আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সমস্যা বড় আকার ধারণ করেছে। মার্জারের কথা শুনে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রাহকরা প্রচুর আমানত তুলে নিয়েছেন। যার কারণে হঠাৎ করে আমরা এতটা সংকটে পড়েছি। এখন শুনছি বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি সহায়তা করবে। যদি বাংলাদেশ ব্যাংক সহায়তা করে, তাহলে সংকট দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শফিক বিন আব্দুল্লাহ দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের কিছু ক্রাইসিস চলছে। আমরা আমানত সংগ্রহের চেষ্টা করছি এবং বিতরণকৃত ঋণগুলোও আদায়ের চেষ্টা করছি। আশা করি আমরা এগুলো ওভারকাম করতে পারব।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৭৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৮৬ কোটি টাকা তথা ৮৬ দশমিক ৯১ শতাংশ খেলাপি ঋণ। এছাড়া ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি ছিল এক হাজার ৮২৩ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের নাম পরিবর্তন করে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক করা হয়। চরম তারল্য সংকটের কারণে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, আমানতকারীদের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকটি। শুধু প্রিন্সিপাল শাখা নয়, আরও বিভিন্ন শাখা থেকে খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে অনেক গ্রাহককে। ব্যাংকটির কাছে মানসম্পন্ন সিকিউরিটিজ না থাকায় তারল্য সহায়তায় সাড়া দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংকও।
গত সপ্তাহে ব্যাংকটির মৌলভীবাজার শাখায় টাকা তুলতে গেলে কোনো টাকা পাননি ১৫ গ্রাহক। একই পরিস্থিতি রাজধানীর পল্টন ও কারওয়ান বাজার শাখায়ও। টাকা তুলতে এসে আমানতকারীরা খালি হাতেই ফিরে যাচ্ছেন। গত বৃহস্পতিবার নয়াপল্টন শাখায় এক গ্রাহক দুই লাখ টাকার চেক নিয়ে গেলে তাকে খালি হাতেই ফিরতে হয়। যদিও শাখা ম্যানেজার আমানতকারীদের আশ্বস্ত করেছেন তারা টাকা তুলতে পারবেন।
জানা গেছে, চরম তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকটি গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জামানতমুক্ত তারল্য সহায়তা হিসেবে ৫০ কোটি টাকা চেয়েছিল। তবে এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ৪২৫ কোটি টাকা দেনা রয়েছে। ফলে নতুন করে তারল্য সহায়তার আবেদনে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিআরপিডি ও ডিওএস ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তারা জানান, মূলধন ঘাটতি, উচ্চ খেলাপি আর তারল্য সংকটে পদ্ধতিগত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। পরিস্থিতি এখন খুবই জটিল পর্যায়ে চলে এসেছে। ব্যাংকটির কাছে এমন কোনো জামানত নেই, যার বিপরীতে অন্য ব্যাংক বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নগদ অর্থ ধার করতে পারবে। কর্মীদের বেতনও ধাপে ধাপে পরিশোধ করা হচ্ছে ব্যাংকটিতে।
এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।