দুর্যোগ মোকাবিলা একটি সমন্বিত কার্যক্রম। দুর্গতদের সাহায্যে আমরা ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছি
—মহিববুর রহমান
প্রতিমন্ত্রী, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড় রেমালে পরিণত হয়ে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে তাণ্ডব চালিয়েছে। যার বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। উপকূলবাসী বলছে, ঘূর্ণিঝড় সিডরকেও হার মানিয়েছে ‘রেমাল’। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাবে উপকূলীয় ১৯ জেলায় ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ঝড়ে ভেঙে পড়েছে কাঁচা ঘরবাড়ি, দেয়াল ও গাছপালা। এক লাখ ৫০ হাজার ৪৭৫টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। বহু জায়গায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে জোয়ারের পানি ঢুকে পড়েছে। প্লাবিত হয়েছে কয়েকশ গ্রাম। বেশিরভাগ অঞ্চলে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের সংকট। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে দেশের উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় দুই কোটি ৭১ লাখ গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। রেমালের তাণ্ডবের সময় ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এসব গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখেছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। ফলে অনেক এলাকা ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা যাবৎ বিদ্যুৎবিহীন রয়েছে।
এদিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশিরভাগ উপকূলীয় এলাকায় এখনও মোবাইল যোগাযোগ নেটওয়ার্কের বাইরে। অনেকে ফোনে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
প্রতিবেদনটি লেখা পর্যন্ত পটুয়াখালী, ভোলা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল ও কুমিল্লায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বরিশাল নগরের রুপাতলী এলাকায় গতকাল ভোর ৪টার দিকে একটি ভবনের ছাদে নির্মাণাধীন দেয়াল ধসে পাশের খাবারের হোটেলের ওপর পড়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন লোকমান হোটেলের মালিক লোকমান হোসেন ও কর্মী মোকসেদুর রহমান। এ ঘটনায় শাকিব নামে এক হোটেলকর্মী আহত হন। তাকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ওই হোটেলের মালিকসহ দুই কর্মচারী তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। তারা টিনের চাল ও দেয়ালের নিচে চাপা পড়েন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসক দুজনকেই মৃত ঘোষণা করেন। ভোলার লালমোহন উপজেলায় ঘরচাপায় মনেজা খাতুন (৫৪) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তার বাবার নাম সিদ্দিক মাঝি। গতকাল ভোর রাতে উপজেলার পশ্চিম চরউমেদ ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ড এলাকায় প্রচণ্ড বাতাসে ঘর ভেঙে পড়লে এ দুর্ঘটনা ঘটে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে শওকাত মোড়ল (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত শওকাত মোড়ল গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের মৃত নরিম মোড়লের ছেলে। গাবুরা ইউপি চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে পটুয়াখালীতে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার দুপুরে কলাপাড়ায় ফুফু ও বোনকে নিরাপদ স্থানে আনতে যাওয়ার পথে জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. শরীফ (২৭) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। ধুলাসর ইউনিয়নের কাউয়ারচর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত শরীফ অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শরীফের ফুপু মাতোয়ারা বেগম কাউয়ারচর এলাকায় বসবাস করেন। ওই বাড়িতে তার বোনও ছিল। দুপুর ২টার দিকে অনন্তপাড়া থেকে শরীফ তার বড় ভাই ও ফুফাকে নিয়ে বোন ও ফুফুকে উদ্ধার করতে যান। এ সময় কাউয়ারচর এলাকা ৫ থেকে ৭ ফুট পানিতে প্লাবিত ছিল। নৌকা না থাকায় সাঁতার কেটে তারা ফুফুর ঘরে যাওয়ার সময় ঢেউয়ের তোড়ে শরীফ হারিয়ে যান। ঘণ্টাখানেক পর ওই স্থান থেকে শরীফের লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। এদিকে বাউফলে ঝড়োহাওয়ায় একটি পরিত্যক্ত টিনশেড দোতলা ঘরের নিচে চাপা পড়ে আব্দুল করিম (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। রোববার রাতে ঝড়ের সময় বৃদ্ধ করিম পরিত্যক্ত ওই ঘরে আশ্রয় নেন এবং রাতের যে কোনো সময় ঝড়োহাওয়ায় ঘর ভেঙে এ ঘটনা ঘটে। বাউফল পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের কাছে এ ঘটনা ঘটে। বৃদ্ধ করিমের বাড়ি বাউফলের নাজিরপুর ইউনিয়নের ধানদি গ্রামে। তিনি ভিক্ষা করতেন।
বাউফল থানার ওসি শোনিত কুমার গায়েন বলেন, মরদেহের পরিচয় পাওয়া গেছে। আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে। কুমিল্লা নগরীতে নির্মাণাধীন একটি ভবনের দেয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম সাগর (১২) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে নগরীর শাকতলা এলাকায় নূর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সাইফুল ইসলাম সাগর ওই প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল। সে শাকতলা এলাকার অলী আহমেদের ছেলে। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) খাদেমুল বাহার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে এক যুবক মারা গেছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বায়েজিদের চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত যুবকের নাম সাইফুল ইসলাম হূদয় (২৬)। তিনি নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ধসেপড়া দেয়ালে চাপা পড়েন। এতে তার মৃত্যু হয়। ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করে গতকাল দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান বলেন, দুর্যোগ মোকাবিলা একটি সমন্বিত কার্যক্রম। দুর্যোগকবলিত মানুষের সাহায্যে আমরা ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের অনুকূলে ছয় কোটি ৮৫ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। যার মধ্যে ১৫ জেলায় জিআর (ক্যাশ) তিন কোটি ৮৫ লাখ নগদ টাকা, পাঁচ হাজার ৫০০ টন চাল, পাঁচ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, শিশুখাদ্য কেনার জন্য এক কোটি ৫০ লাখ ও গোখাদ্য কেনার জন্য এক কোটি ৫০ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সতর্কতার পরিপ্রেক্ষিতে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৯ হাজার ৪২৪টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।
এসব আশ্রয়কেন্দ্র ও স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আট লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গরু, মহিষ, ছাগল-ভেড়াসহ আশ্রিত পশুর সংখ্যা ৫২ হাজার ১৪৬। এছাড়া দুর্গত মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতে এক হাজার ৪৭১টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে।