সরকারকে কর থেকে ‘রেভিনিউ জেনারেট’ বাড়াতে হবে
—মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন অর্থনীতিবিদ
মনে হচ্ছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথে হাঁটছে দেশ
—সুমন কান্তি বাড়ৈ রনি সাংগঠনিক সম্পাদক, স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ
বাজেট ঘাটতির অংশ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার গ্রহণ করলে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ অনেক কমে যাবে
—শেখ ইসমাইল হোসেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা
দেশে টানা চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনা করছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। এ সরকারের বর্তমান মেয়াদের প্রথম বাজেট ঘোষণা হতে যাচ্ছে আগামী মাসের শুরুতেই। জাতীয় সংসদে এ-সংক্রান্ত অধিবেশন শুরু হচ্ছে আগামী ৫ জুন। এটা নতুন সরকারের প্রথম বাজেট হওয়ায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনসহ জনমনে রয়েছে যথেষ্ট কৌতূহল। গত কয়েক বছর ধরে দুর্ভিক্ষ ও চরম অর্থনৈতিক টানাপড়েনের আশঙ্কা করা হলেও দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতিতে পড়েনি বাংলাদেশ। তবে অর্থনৈতিক টানাপড়েনের মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে গত বেশ কয়েক বছর।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আকারের বাজেট। সাত লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার সেই বাজেটের আকার ছিল আগের বাজেটের চেয়ে ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ বেশি। কয়েক বছরের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বাজেটের আকার সাধারণত ৮-১২ গুণ বেড়েছে। তবে নতুন বছরের এ বাজেটে সেই ধারার পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। চলতি বছর থেকে সামান্য বেশি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এ বাজেটের আকার। ধারণা করা হচ্ছে, এ বাজেটের আকার হতে পারে ৮ থেকে সাড়ে ৮ লাখ কোটি টাকা।
নতুন এ বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ পুরাতন সমস্যাগুলোই। মূল্যস্ফীতি, ডলারের দাম বৃদ্ধি, আমদানিনির্ভরতা এ বাজেটেও প্রভাব ফেলবে। ডলারের দাম নতুন করে বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে তাল মিলিয়ে। পুরাতন এসব সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাংক খাতের অস্থিরতাও।
সম্প্রতি ব্যাংক খাতের অস্থিরতায় টালমাটাল দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ। চলতি বাজেটের ব্যয় মেটাতে সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ গ্রহণ করেছে। একই অবস্থা দেখা যাবে এবারের বাজেটেও। বাজেটের ঘাটতি পূরণ করতে এবারও ঋণ করতে যাচ্ছে সরকার। এতে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ অনেক কমে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন ব্যাংক সেক্টরের কর্মকর্তারা।
বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা শেখ ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘বাজেট ঘাটতির অংশ ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার গ্রহণ করলে বেসরকারি ঋণপ্রবাহ অনেক কমে যাবে। অপরদিকে সরকারের ক্রমবর্ধমান ঋণের সুদহার বৃদ্ধির কারণেও ঋণ বিতরণ কমে যাবে। এর প্রভাব পড়বে আমদানি, রপ্তানি, কর্মসংস্থান, সম্পূরক শুল্ক আদায়সহ নানা খাতে।’
এ ছাড়া হঠাৎ করেই বেড়েছে ডলারের দাম। আগের মতো ক্রমেই কমে চলেছে রিজার্ভের পরিমাণ। এবারের বাজেট প্রদানের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো বড় প্রভাব রাখতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ব্যাংক খাতের অস্থিরতায় বর্তমান বাজেটে প্রভাব ফেললেও তা সামলে নেয়া সম্ভব বলে মনে করছেন অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা। স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক ও বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক সুমন কান্তি বাড়ৈ রনি আমার সংবাদকে বলেন, ‘ব্যাংক খাত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির মধ্যে একটা ভারসাম্যমূলক বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। সুদহার উন্মুক্ত করার কারণে মনে হচ্ছে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির পথে হাঁটছে দেশ। বাজেট প্রবৃদ্ধি আগের বছরগুলোর তুলনায় অনেক কম। ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ব্যাংকের তারল্য সংকটের সমাধানের পথ এই বাজেটে থাকুক, তা প্রত্যাশা করি।’
চলতি বাজেটে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনা। কিন্তু সাড়ে ছয় শতাংশে তো নামেইনি, উল্টো সম্প্রতি মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ফলে এ সংকট আবারও বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে আসছে বাজেটের ক্ষেত্রে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও জানিয়েছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে আগামী বাজেটের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তাই এ বাজেট হতে যাচ্ছে ব্যয় সংকোচনমুখী। ব্যয় সংকোচন করতে আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতে চাচ্ছে সরকার। ফলে আমদানিযোগ্য অনেক পণ্যেই নতুন কর সংযোজন হতে পারে। এছাড়া সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানিও বন্ধ হতে যাচ্ছে। এবারের বাজেটের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক বসতে যাচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এবার করছাড় কমানোর পাশাপাশি বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি (অনুদান ছাড়া) দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হতে পারে। এ বাজেটে পুনর্বিন্যাস হতে পারে করহার। করমুক্ত আয়সীমা থেকে এক লাখ টাকার ওপর বর্তমানে প্রচলিত পাঁচ শতাংশ করের স্তর উঠিয়ে দেয়ার পাশাপাশি ২৫ শতাংশ করহারের পর ৩০ শতাংশের আরেকটি স্তর যোগ করার পরিকল্পনা করছে সরকার। সে ক্ষেত্রে নতুন করহার হতে পারে ১০, ১৫, ২০, ২৫ ও ৩০ শতাংশ।
বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, এবারের বাজেটে কর অবকাশ সুবিধা পেতে যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি সেবার বিভিন্ন খাত। এর মধ্যে রয়েছে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন কাস্টমাইজেশন, ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন), ডিজিটাল অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েবসাইট সার্ভিস, ওয়েব লিস্টিং, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, ডিজিটাল গ্রাফিকস ডিজাইন, ডিজিটাল ডেটা এন্ট্রি অ্যান্ড প্রসেসিং, ডিজিটাল ডেটা অ্যানালিটিকস, গ্রাফিকস ইনফরমেশন সার্ভিস (জিআইএস), আইটি সাপোর্ট অ্যান্ড সফটওয়্যার মেইনটেন্যান্স সার্ভিস, সফটওয়্যার টেস্ট ল্যাব সার্ভিস, কলসেন্টার সার্ভিস, ওভারসিজ মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন সার্ভিস, ডকুমেন্ট কনভারশন, ইমেজিং অ্যান্ড ডিজিটাল আর্কাইভিং, রোবোটিক প্রসেস আউটসোর্সিং, সাইবার সিকিউরিটি সার্ভিস, ক্লাউড সার্ভিস, সিস্টেম ইন্টিগ্রেশন, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, ই-বুক পাবলিকেশন, মোবাইল অ্যাপ ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস ও আইটি ফ্রিল্যান্সিং।
এবারের বাজেটে অগ্রিম আয়কর (এআইটি), ভ্যাট আইনের আওতায় আগাম কর (এটি) প্রত্যাহার, ব্যাংকঋণের সুদহার হ্রাসসহ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব জানানো হয়েছে সরকারের কাছে। সরকারের পক্ষ থেকে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীও ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, সরকার দেশের প্রতিটি নাগরিকের মতামতের গুরুত্ব দেয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটের জন্য ব্যবসায়ীদের দেয়া প্রস্তাবসমূহ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করা হবে। তবে বড় প্রজেক্টগুলোর ‘কোয়ালিটি চেক’-এর মাধ্যমে খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আমজাদ হোসেন।
আমার সংবাদকে তিনি বলেন, সরকারকে কর থেকে ‘রেভিনিউ জেনারেট’ বাড়াতে হবে। অন্যান্য দেশে এর পরিমাণ বেশি। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে। সাধারণ মানুষের সামাজিক নিরাপত্তার দিকে আরও বেশি নজর দিতে হবে সরকারকে। বড় বড় প্রজেক্টের পাশাপাশি ছোট প্রজেক্টেও গুরুত্বারোপ করতে হবে। আর বড় প্রজেক্টের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো ‘কোয়ালিটি চেক’ আরও সূক্ষ্মভাবে করা প্রয়োজন। তবে এ বাজেটের পূর্ণাঙ্গ চিত্র দেখতে অপেক্ষা করতে হবে আগামী জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত।