শ্রম মন্ত্রণালয়ের ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন’ প্রকল্প পাইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্তত ৫৫ এনজিও কর্মকর্তার কাছ থেকে নগদ ঘুসসহ অগ্রিম ‘ব্ল্যাংক চেক’ হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তথ্য অধিদপ্তরের সে সময়ের সহকারী তথ্য কর্মকর্তা আলী হোসেন ও তার সহযোগীরা বড় অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে অভিনব এই জালিয়াতিতে জড়ান। চেকের পাশাপাশি ৫৫ এনজিও কর্মকর্তার কাছ থেকে জনপ্রতি পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা ঘুসও নিয়েছেন তিনি। পরে ওইসব ব্ল্যাংক চেকে ইচ্ছেমতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে টাকা তোলার চেষ্টা করেন। চেকের বিপরীতে ব্যাংক হিসাব নম্বরে টাকা না থাকায় সেগুলো ডিজঅনার হয়। এরপর একাধিক এনজিও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতারক আলী হোসেন আদালতে চেক জালিয়াতির মামলা করেন। সাজানো এসব মামলায় দীর্ঘদিন ধরে নাজেহাল এনজিও কর্মকর্তারা। আলী হোসেনের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় ২০২০ সালের নভেম্বরে তথ্য অধিদপ্তর থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়। তার এমন জালিয়াতিসহ আরও একাধিক অভিযোগের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা ও সাধারণ ডায়েরির কপি পেয়েছে আমার সংবাদ।
সার্বিক কাগজপত্র পর্যালোচনা করে জানা যায়, ২০১৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের (৪র্থ পর্যায়) বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শ্রম মন্ত্রণালয়। প্রকল্প পরিচালক ছিলেন সে সময়ের যুগ্ম সচিব (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) আব্দুর রাজ্জাক। পিডি রাজ্জাকের সঙ্গে সখ্য রয়েছে— এনজিও কর্তৃপক্ষের কাছে এমন দাবি করে প্রকল্প পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন আলী হোসেন। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভস নামের সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধান তৈয়বা খানমও প্রকল্পের জন্য আবেদন করেন। তথ্য অধিদপ্তরের সহকারী তথ্য কর্মকর্তা আলী হোসেন কাজ পাইয়ে দেয়ার কথা বলে তার কাছেও পারিশ্রমিক দাবি করেন। সরল বিশ্বাসে তিনি রাজি হয়ে আলী হোসেনকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেন। পরে কাজ না পেয়ে চেক ফেরত চান। ফেরত না দিয়ে চেকে ২৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা লিখে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে উত্তোলনের চেষ্টা করেন আলী হোসেন। টাকা তুলতে না পেরে ঢাকার আদালতে তৈয়বার নামে চেক জালিয়াতির মামলা করেন। তৈয়বা খানমের মতো এভাবে অন্তত ৫৫ এনজিও কর্মকর্তার কাছ থেকে অগ্রিম ‘ব্ল্যাংক চেক’ নেন আলী হোসেন ও তার সহযোগীরা।
টাকা হাতিয়ে নিতে এনজিও কর্মকর্তাদের ফাঁসানোর পর উল্টো তাদের বিরুদ্ধেই বেশকিছু মামলা করেছেন আলী হোসেন ও তার সহযোগীরা। সেসব মামলার এজাহার বিশ্লেষণে দেখা যায়, অভিযোগগুলো প্রায় এক ও অভিন্ন। সেখানে দাবি করা হয়, ব্যবসায়িক সূত্রে চেকদাতার সঙ্গে তার লেনদেনের সম্পর্ক। আলী হোসেনের ছোট ভাই আলী আকবর চেকের টাকা ব্যবসায়ীদের ধার দিয়েছেন। ২৩ চেকের মধ্যে ২১টিতে ৯০ লাখ টাকা এবং একটিতে ২৫ লাখ ৫০ হাজার; অপরটিতে ২৫ লাখ টাকার অঙ্ক বসানো হয়। সে হিসেবে টাকা পাওনা দেখিয়েছেন ১৯ কোটি ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
জানা গেছে, আলী হোসেনের ভাই আলী আকবর গ্রাম্য পশুচিকিৎসক। তাদের বাবা (মৃত) আব্দুল জলিল মেহেরপুরের দলিল লেখক ছিলেন। তাদের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর সদরের গোভীপুরে। প্রশ্ন উঠেছে, একজন সরকারি কর্মকর্তা ও তার ভাই এত টাকা কোথায় পেলেন যে, ধার দেয়ার দাবি করছেন! এদিকে ভুক্তভোগী এনজিও কর্মকর্তারা আমার সংবাদকে জানান, আলী হোসেনের করা মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। প্রতি মাসে এক-দুবার হাজিরা দিতে হচ্ছে আদালতে। অন্যদিকে জালিয়াতির মাধ্যমে এখনও টাকা আত্মসাতের চেষ্টা চালাচ্ছেন আলী হোসেন। প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরা আলী হোসেন ও তার চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেন। এর মধ্যে দুটি মামলা তদন্ত করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এবং অপর দুটি তদন্ত করে আদাবর ও কাফরুল থানা পুলিশ। চারটি মামলাতেই আলী হোসেন ও তার চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার তথ্যপ্রমাণ পান তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। চার মামলারই অভিযোগপত্র জমা হয়েছে আদালতে। শুধু ভুক্তভোগীদের মামলাতেই নয়, আলী হোসেন ২০২০ সালে দুটি এনজিও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পুলিশ সদর দপ্তরেও হয়রানির অভিযোগ করেন। সেটি তদন্ত করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। নিজের করা অভিযোগেও ফেঁসেছেন তিনি। তার করা অভিযোগও তার বিরুদ্ধেই গেছে। আদালতের নির্দেশে এনজিও কর্মকর্তা তৈয়বার মামলাটি তদন্ত করে পিবিআই। আলী হোসেনের বিরুদ্ধে তৈয়বার করা অভিযোগের সত্যতাও পান তদন্ত কর্মকর্তা।
তৈয়বা খানমসহ সোশ্যাল অ্যাডজাস্টমেন্ট ও ভিলেজ ইকোনমিকের নির্বাহী পরিচালক মজিবর রহমান, ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন ফর রুরাল ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক এমরানুল হক কামালসহ অধিকাংশ ভুক্তভোগীই আমার সংবাদকে বলেন, আলী হোসেন পৃথক পৃথকভাবে আমাদের প্রকল্প পাইয়ে দেয়ার কথা বলে টাকা ও চেক নেন। যেহেতু আমরা একে অপরের সঙ্গে পূর্বপরিচিত ছিলাম না, তাই বিষয়টি আমরা জানতাম না। তার প্রতারণার ফাঁদ ও মামলার পরই জালিয়াতির বিষয়টি আমরা জানতে পারি এবং একে একে ২২ জনই পরিচিত হই। তবে আমরা জানতে পেরেছি তার এই প্রতারণার কবলে পড়েছেন অন্তত ৫৫ জন। যাদের সবার কাছ থেকেই নেয়া ব্ল্যাংক চেক দিয়ে এখন ব্ল্যাকমেইল করছেন তিনি। ভুক্তভোগীরা বলেন, একজন সাবেক সচিবকেও হত্যার হুমকি দিয়েছিলেন আলী হোসেন। পরিবারসহ ওই সচিবকে অবরুদ্ধ জীবনযাপনও করতে হয়েছে তার হুমকিতে।
এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কলাবাগান ও নিউমার্কেট থানায় পাঁচটি সাধারণ ডায়েরিও হয়। শুধু তা-ই নয়, চাকরি দেয়ার কথা বলেও অন্তত ৬০০ চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকেও ব্ল্যাংক চেক নেন আলী হোসেন। এসব বিষয়ে জানতে আলী হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাতে সংযোগ পাওয়া যায়নি।