নিজের নির্ধারিত কমিশন ছাড়া ফাইলে হাত দেন না পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শেখ মো. জামিনুর রহমান। তার বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ তুলেছেন খোদ ব্যাংকের কর্মীরা। অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি-বাণিজ্যের জন্য ব্যাংকের ভেতর পৃথক শাখা খুলেছেন— এমন অভিযোগ ব্যাংকটির সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর দেয়া অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশির্বাদপুষ্ট চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমান এসব অপকর্মের মূলহোতা। তার সব অপকর্মের অন্যতম সহযোগী ব্যাংকটির সিস্টেম এনালিস্ট আল্লামা মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া তানহার ও মো. শাহেদ আলমগীর। মূলত তারাই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ধারাবাহিকভাবে এসব অপকর্ম করে আসছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমানের ছত্রছায়ায় আল্লামা মোহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া তানহার ও মো. শাহেদ আলমগীর ঘুষ-বাণিজ্য, অবৈধ কেনাকাটাসহ সীমাহীন দুর্নীতির মচ্ছবে মেতে উঠেন ব্যাংকটিতে। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করা তিন সদস্যের এই সিন্ডিকেটের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে বাধ্য হয়েই নীরব থাকলেও সর্বশেষ হাসিনা সরকারের পতনের পর তাদেরও পদত্যাগের দাবি জানিয়ে এখন সরব হয়ে উঠেছেন বঞ্চিতরা।
জানা গেছে, শুক্রবার ব্যাংক ছুটি থাকলেও অর্থের বিনিময়ে জেলা কর্মকর্তাদের শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন জামিনুর। যা ব্যাংকের অর্ডারে উল্লেখ করেছেন গত ১৫ আগস্ট। হালের সময়ে তাড়াহুড়ো করেই জনপ্রতি তিন লাখ টাকার বিনিময়ে মাঠকর্মীদের পদোন্নতি দেয়ার প্রক্রিয়াও চালাচ্ছেন তিনি। এছাড়া ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে উচ্চমূল্যে অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা করে ব্যাংকের বিপুল অর্থ ও সম্পদের ক্ষতি সাধন করছেন তিনি। শুধু তাই নয়, স্বেচ্ছাচারিতা, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্বৃত্তায়ন, অভ্যন্তরীণ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় উত্তরপত্র টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ঘুষ গ্রহণ, মামলা-বাণিজ্য, অর্থের বিনিময়ে শাস্তি মওকুফসহ প্রতিষ্ঠানটির সব সেক্টরেই দুর্নীতি ও ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিকও বনে গেছেন এমডি জামিনুর রহমান।
ব্যাংকটির একটি সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই ব্যাংক খাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থাভাজন হিসেবে ব্যাপক পরিচিত জামিনুর রহমান এখন চাকরি হারানোর ভয়ে দিন পার করছেন। তাই বেপরোয়া নিয়োগ-বাণিজ্যে ও পদায়নের মাধ্যমে নিজের আখের ঘোছাচ্ছেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা আমার সংবাদকে জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও দেশ ছেড়ে পালানোর পর থেকেই এমডি ও তার সহযোগীদের নির্যাতনের শিকার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিক্ষোভ করে আসছেন। বিক্ষোভ দমনে অজ্ঞাত স্থান থেকে এমডি জামিনুর রহমান বিশেষ সুবিধা পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে আসার মৌখিক নির্দেশনাও দেন। ফলে দুপক্ষের মধ্যকার অবস্থান এখন সংঘাতের মুখোমুখি।
সদ্য নিয়োগ পাওয়া ব্যাংক কর্মীদের অভিযোগ, ৪৯২ জন অফিস সহকারী ও ৭২ জন নিরাপত্তা প্রহরী নিয়োগ দিয়েছেন এমডি। এ জন্য তাকে জনপ্রতি প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলছেন, ব্যাংক থেকে লোন নিলেই এমডিকে দিতে হতো কমিশন। তার ধার্যকৃত কমিশন না হলে লোনও পাস হতো না। গৃহঋণের ক্ষেত্রে দুই লাখ মোটরসাইকেলের জন্য ৩০ হাজার টাকা কমিশন দিতে হতো তাকে। ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের জন্য উচ্চমূল্যে অপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে উৎসাহী ছিলেন তিনি। ৭০ হাজার টাকার ল্যাপটপ কিনেছেন দুই লাখ টাকায়, কর্মীদের ট্রেনিংয়ে দুপুরের খাবার বাবদ ৪০০ টাকা দেখানো হলেও খাবার পরিবেশন করা হয়েছে ১০০ টাকার। কর্মীদের সাসপেনশন তুলতে কমপক্ষে এক লাখ টাকা নেয়া হয়। পদ অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্কের টাকার বিনিময়ে (এক থেকে পাঁচ লাখ) বদলি করা হয়। ব্যাংকের সব শাখা অফিস, জেলা অফিস ও প্রধান কার্যালয়ে ৬০০ অ্যাটেনডেন্স মেশিন কেনা হয়েছে। যার প্রতিটির মূল্য ১১ হাজার টাকা। অথচ বিল দেখিয়েছেন ২৮ হাজার টাকা করে। এছাড়া ভুয়া বিল, টেন্ডার বাণিজ্যসহ ব্যাংকের প্রায় প্রতিটি খাতেই অপকর্ম করেছেন শেখ হাসিনার আস্থাভাজন এই কর্মকর্তা।
এমতাবস্থায় প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার নিশ্চিতকরণ, বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক নিশ্চিত করতে ব্যাংকের সব স্তরের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করছেন। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এ জন্য ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এমডির অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে গত ১৪ ও ১৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর অভিযোগও প্রদান করেছেন তারা।
উত্থাপিত এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের এমডি শেখ মো. জামিনুর রহমান বলেন, এই ব্যাংকের ১২ হাজার কর্মীর কাছে জিজ্ঞাসা করেন আমি তাদের কাছে কী দেবতা না অন্যকিছু। শুক্রবার ব্যাংক খোলা রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুক্রবার ব্যাংক খোলা ছিলো না। ব্যাংকের বদলি-সংক্রান্ত একটি সিদ্ধান্ত আগেই চূড়ান্ত করা হয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলায় এতদিন সেই সিদ্ধান্ত কর্মীদের জানানো হয়নি, বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত হলেও ওয়েবসাইটে সমস্যার কারণে তা গত ১৫ আগস্ট বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে শুক্রবার ওয়েবসাইট আপলোড করা হয়েছে।
পদোন্নতি বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি বলেন, এই ব্যাংকে আমার আমলেই পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার নামের আগে শেখ থাকায় ফায়দা নিতে চাইছে স্বার্থান্বেষী মহল। লাঞ্চ বিলের প্রসঙ্গে জামিনুর রহমান বলেন, ‘আমি এই ব্যাংকে কর্মীদের জন্য ৭০ টাকায় লাঞ্চের ব্যবস্থা করেছি। এখন আমার বিরুদ্ধে যদি কেউ একটি অভিযোগও প্রমাণ করতে পারে; তাহলে ল্যাংটা হয়ে ব্যাংক ছাড়ব।’ ল্যাপটপ ক্রয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা ওপেন টেন্ডারে হয়েছে। এখানে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই।’