বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর নতুন রূপে দেশ গঠনে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বিগত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দীর্ঘদিন পদোন্নতি বঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার হয়ে আসা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের ভেতরে-বাইরে শোডাউন ও মিছিল-মিটিং অব্যাহত রেখেছেন। তাদের লাগাতার শোডাউনে প্রশাসনের বৈষম্যের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারে বেড়েছে অস্বস্তি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশাসনের ভেতরে অস্থিরতা বন্ধ করতে হলে এর প্রকৃত কারণ খুঁজে দেখা দরকার। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাবস্থায় সব সেক্টরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয়করণ করেছে। যারা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি, তাদের পদোন্নতি আটকে দেয়। দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভূত এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূরীকরণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপর চাপ বাড়বে।
সরেজমিন গত কয়েকদিন সচিবালয় ঘুরে দেখা গেছে, পদোন্নতি বঞ্চনায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি (নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রেষণ) অনুবিভাগের বারান্দায় দফায় দফায় মহড়া দিচ্ছেন কর্মকর্তারা। বাংলাদেশ সচিবালয় বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী সংগঠনের ব্যানারে সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেন ১০ম-২০তম গ্রেডের এক দল কর্মচারী। বাদ যায়নি আইসিটি ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও। একইসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরাও ফুঁসে উঠছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের পদোন্নতির জন্য দীর্ঘদিন প্রায় ২০টি পদ ফাঁকা থাকলেও তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি। ফলে প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও), ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) এবং অফিস সহায়করা পদোন্নতির দাবিতে মন্ত্রণালয়ে শোডাউন করেছেন। কর্মচারীরা চাকরিতে বৈষম্য দূরীকরণে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের সামনে বিক্ষোভ করেন। নতুন করে নিয়োগ বিধিমালা তৈরি করে পদোন্নতি দেয়ারও দাবি জানানো হয়। গতকাল সচিবালয়ের বাইরে প্রতিবন্ধী স্কুলের কার্যক্রম চালুর দাবিতে শত শত লোক সড়কে বসে বিক্ষোভ করেন। এছাড়াও রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকশ কর্মী রেশনের দাবিতে সচিবালয়ের সামনের সড়কে শোডাউন করে। এতে করে গতকাল দুপুর ১টার দিকে সচিবালয়ের সব গেট বন্ধ করে দেয়া হয়।
গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মাসুদুল হাসানের দপ্তর ঘিরে রাখেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও), ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) এবং অফিস সহায়করা। তারা বলেন, সবাইকে ফিডার পদ দিতে হবে। সেজন্য আগে একটি পরিপত্র জারি করা হোক, এরপর নিয়োগবিধি পরিবর্তন করুক। কারণ চাকরির নিয়োগবিধি পরিবর্তনে বহু সময় লাগবে। সুতরাং পরিপত্র জারি করে আমাদের আশ্বাস করুক যে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগ পরবর্তীতে নিয়োগবিধি সংশোধন করবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয়করণ করা হয়েছে। সরকারি কাজ ছেড়ে যারা দলীয় লেবাসের পেছনে ছুটেছেন তাদের দ্রুত পদোন্নতি দেয়া হয়। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বঞ্চিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন ধরনের দাবি তুলছেন। একসঙ্গে সবাই বৈষম্য দূরীকরণের দাবি তোলায় কিছুটা চাপে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
বৈষম্যের শিকারের অভিযোগ তুলে সচিবালয়ের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা সাত দাবি তুলেছেন। বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তা শিরোনামে বেশকিছু সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। এর মধ্যে নিরপেক্ষ প্রশাসনের লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও আস্থা জ্ঞাপন, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সব পদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ অবিলম্বে বাতিল করা। বর্তমান সচিবদের ‘দলবাজ’ আখ্যা দিয়ে তাদের অপসারণ করে ‘বৈষম্যের শিকার’ কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মেধা ও দক্ষতার ভিত্তিতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সচিব পদে পদায়ন করার জোর দাবি জানানো হয়। বিভিন্ন ক্যাডার থেকে সরকারের পুলে উপ-সচিব পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের বাইরে অন্য ক্যাডার থেকে আসা অন্তত দুইশ কর্মকর্তা এমন বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। যে কারণে গত শনিবার বঞ্চিত প্রায় ২০০ উপ-সচিব বৈষম্য নিরসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব ও এপিডির কাছে দাবি জানান।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিসিএস ২৮তম ব্যাচ থেকে ৪২তম ব্যাচে বিভিন্ন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পরও নিয়োগবঞ্চিতরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে জড়ো হন। তাদের দেয়া তথ্যমতে, ৩৩তম বিসিএসে সবচেয়ে বেশি নিয়োগবঞ্চিত করা হয়, এই সংখ্যা ১১৩ জন, ৩৯তম বিসিএসে ৬৯ জন, ৩৬তম বিসিএসে ৬৯ এবং ৩৭তম বিসিএসে ৬১ জনকে নিয়োগবঞ্চিত করা হয়। পিএসসি থেকে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার পর তাদের নিয়োগবঞ্চিত করা হয়েছে। তাদের নিয়োগ দিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়।
বাংলাদেশ সচিবালয় বৈষম্যবিরোধী কর্মচারী সংগঠনের ব্যানারে সচিবালয়ে বিক্ষোভ করে ১০ম-২০তম গ্রেডের এক দল কর্মচারী। বাংলাদেশ আইসিটি অফিসার্স ফোরাম সচিবালয়ের এক নম্বর ভবনের সামনে ব্যানার নিয়ে দাঁড়ায়। আইসিটি অফিসারদের জন্য স্বতন্ত্র আইসিটি ক্যাডার চালুর জন্য চূড়ান্ত প্রস্তাব এক মাসের মধ্যে অনুমোদন করাসহ ১৩ দফা দাবি জানায় ফোরামটি।
তাদের দাবিগুলো হচ্ছে—
১. আইসিটি অফিসারদের জন্য স্বতন্ত্র আইসিটি ক্যাডার চালুর জন্য ইতোমধ্যে চূড়ান্তকৃত প্রস্তাব এক মাসের মধ্যে অনুমোদন করতে হবে।
২. নাগরিকদের জন্য ডিজিটালাইজেশনের প্রকৃত সুফল নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে আইসিটি অফিসারদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. আইসিটি অফিসারদের পদগুলোকে রুলস অব বিজনেস-এ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৪. কেন্দ্রীয়ভাবে বদলি/পদোন্নতির সুযোগ সৃষ্টিকরণসহ মেধা, সততা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদায়ন ও পদোন্নতির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৫. সব মন্ত্রণালয়/বিভাগে আইসিটি কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত স্বতন্ত্র আইসিটি অনুবিভাগ স্থাপন করতে হবে।
৬. মন্ত্রণালয়/বিভাগের অধীন সব দপ্তর/সংস্থায় আইসিটি জনবলের সমন্বয়ে স্বতন্ত্র আইসিটি ইউনিট স্থাপন করতে হবে।
৭. আইসিটি অধিদপ্তরসহ আইসিটি নির্ভর সব দপ্তরের কারিগরি এবং প্রশাসনিক সব পদে আইসিটি কর্মকর্তাদের পদায়ন করতে হবে।
৮. জেলা এবং উপজেলা কার্যালয়ে সংশ্লিষ্ট আইসিটি কর্মকর্তাকে দপ্তর প্রধান করতে হবে।
৯. এজেন্সি টু ইনোভেট (এটুআই), বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি), বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটি, ইলেকট্রনিক স্বাক্ষর সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় (সিসিএ), তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তর, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সি, বাংলাদেশ ডাটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড, স্টার্ট আপ বাংলাদেশ লিমিটেড ইত্যাদিতে প্রধানের পদে আইসিটি কর্মকর্তাদের মধ্য হতে নির্বাচন করতে হবে।
১০. ইনস্টিটিউট অব ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির আইন সংশোধন করে প্রধানের পদে আইসিটি কর্মকর্তা নিয়োগ প্রদানের সুযোগ সৃষ্টিকরণ ও আইএফটিকে পিএটিসি ন্যায় ট্রেনিং সেন্টারে পরিণত করতে হবে।
১১. আইসিটি অধিদপ্তরের আওতাধীন ন্যাশনাল সফটওয়্যার ডেভলপমেন্ট সেন্টার স্থাপন করা যেখানে সরকারের সব সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট থেকে শুরু করে মেইনটেন্যান্স নিশ্চিত করা যা শুধুমাত্র সরকারি দপ্তরের সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট/মেইনটেন্যান্স নিশ্চিত করবে। এজন্য প্রয়োজনীয় জনবল, প্রশিক্ষণ, পরিচালন ব্যয় ও প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে।
১২. নবম গ্রেড তদূর্ধ্ব পদে সরাসরি নিয়োগ বন্ধ করে গ্রেড-১ এর পদ সৃষ্টি করতে হবে।
১৩. আইসিটি পার্সোনেলদের পদনাম পরিবর্তনের ব্যবস্থাকরণ; যেমন- সচিবালয়ে সহকারী সচিব (আইসিটি), দপ্তর/সংস্থায় ও মাঠ পর্যায়ে সহকারী পরিচালক (আইসিটি) উচ্চতর পদসমূহে এ নীতি অবলম্বন করা। অন্যদিকে নন-ক্যাডার পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা পদোন্নতির দাবিতে সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেন।