ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে ‘দখলদার’ এস আলম গ্রুপকে বের করে দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই অংশ হিসেবে ভেঙে দেয়া হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ। একই সঙ্গে গঠন করা হবে স্বাধীন পরিচালনা পর্ষদ। গত ২০ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এ কথা বলেন।
ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হবে জানিয়ে গভর্নর ডা. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংকের জন্য নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’ সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ‘ব্যাংক থেকে এস আলমের নেয়া সব ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তাদের শেয়ার সরকারের জিম্মায় থাকবে। তবে কী পরিমাণ শেয়ার এস আলমের আছে তা খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে বলেও জানান গভর্নর। গভর্নর বলেন, ‘এস আলম সংশ্লিষ্টদের নামে থাকা শেয়ার বের করা সহজ হবে। তবে বেনামে থাকা শেয়ার বের করতে সময় লাগবে।’ এস আলমের লুট করা টাকা উদ্ধারে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ ও সিআইডি একসঙ্গে কাজ করবে বলেও জানান গভর্নর। বর্তমানে ব্যাংকটির ৮২ শতাংশ শেয়ার এস আলমের হাতে থাকায় আপাতত ব্যাংকটিতে সব স্বতন্ত্র পরিচালক দেয়া হবে। পরবর্তীতে আগের পরিচালকরা ২ শতাংশ করে শেয়ার কিনে আসার পর তাদের পরিচালক নিয়োগ দেয়া হবে।
২০১৭ সালে ইসলামী ব্যাংক দখলে নেয় এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির মালিকানা নেয়ার পর থেকে নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। ব্যাংকটির শেয়ারের ৮২ শতাংশের মালিকানা রয়েছে এস আলমের হাতে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকা শেয়ার হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ইসলামী ব্যাংক দখলের পর নামে-বেনামে ২৪ প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১৩১ কোটি ৮৯ লাখ ১২ হাজার ১৬৫টি শেয়ারের মালিকানা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৮১ দশমিক ৯২ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ও সাইফুল আলম মাসুদের (এস আলম) ছেলে আহসানুল আলমের মালিকানাধীন জেএমসি বিল্ডার্সের নামে শেয়ার রয়েছে তিন কোটি ২৩ লাখ ৬০ হাজার ৮১২টি, যা ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এ ছাড়া বিটিএ ফাইন্যান্স, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল, এবিসি ভেঞ্চারস, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, প্লাটিনাম এনডেভার্স, এক্সেলশিয়ার ইমপেক্স, গ্র্যান্ড বিজনেস, লায়ন হেড বিজনেস রিসোর্সেস, বিএলইউ ইন্টারন্যাশনাল, আর্মদা স্পিনিং মিলস, কিংসওয়ে এনডেভার্স, ইউনিগ্লোব বিজনেস, সোলিভ ইন্স্যুরেন্স, হলিস্টিক ইন্টারন্যাশনাল, হাই ক্লাস বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, ক্যারেলিনা বিজনেস, ব্রিলিয়ান্ট বিজনেস, ব্রডওয়ে ইম্পেক্স, পিকস বিজনেস, এভারগ্রিন শিপিং, ম্যারাথন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, কিংস্টোন ফ্লাওয়ার মিলস ও পারসেপ্টা এনডেভার্স। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে দুই থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত শেয়ার রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ছয়টি ব্যাংকে গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম ও তার পরিবারের ২৫ সদস্যের নামে থাকা ৫৬টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বিক্রি ও হস্তান্তরের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বিএসইসি। গত মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।
এদিকে ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আনোয়ার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের কাছে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে সই করেছেন ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালক মো. শহীদুল ইসলামও। ওই চিঠিতে এস আলমের দুর্নীতির বর্ণনা তুলে ধরে ব্যাংকটি রক্ষায় তিনটি দাবি তুলে ধরা হয়েছে।
চিঠিতে বলা হয়, ইসলামী ব্যাংকের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে গ্রাহকদের আস্থা ও স্বার্থ রক্ষার্থে জরুরিভিত্তিতে কার্যকরী পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছি। চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে ইসলামী ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার নিয়ন্ত্রণ নেয় ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ট এস আলম গ্রুপ। তারা ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতায় অবৈধভাবে ব্যাংক দখল করে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের কোনো শেয়ার ছিল না। ২০১৬ সালে সাতটি অস্তিত্বহীন কোম্পানি নিয়ে ১৪ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ শেয়ার নেয়, যা বর্তমানে প্রায় ৮২ শতাংশ শেয়ার। নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব নির্দিষ্ট সার্কুলার, লিখিত পরীক্ষা, ভাইভা ছাড়াই প্রায় ৯ হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এসব কর্মকর্তার বেশির ভাগই সাইফুল আলমের নিজ জেলা চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার। ২০১৬ সালে ব্যাংকে কর্মকর্তা ছিল ১৩ হাজার ৫৩৯ জন, যা ব্যাংকের নিয়ম-নীতি না মেনে ২০২০ সালে ২০ হাজার ৮০৯-এ তুলে আনা হয়। পাশাপাশি এস আলম গ্রুপ অস্তিত্বহীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ফার্মের নামে-বেনামে নৈতিকতার ভিত্তিতে ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কায়দায় অনেক বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেছে। ফলে ব্যাংকের নীতি নৈতিকতা ও আদর্শের পতন ঘটে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর ধীরে ধীরে শেয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয় ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), দুবাই ইসলামী ব্যাংক, আল-রাজি গ্রুপ, সৌদি কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড টুরিস্ট এজেন্সিসহ বেশিরভাগ উদ্যোক্তা ও সাধারণ শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান। এছাড়া অনেক দেশি প্রতিষ্ঠানকে ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণে নেয়ার আগে বিদেশিদের শেয়ার ছিল ৫২ শতাংশের মতো, যা এখন ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
চিঠিতে গভর্নরের কাছে তিন দফা দাবি তুলে ধরেন ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আনোয়ার ও ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও পরিচালক মো. শহীদুল ইসলাম। ব্যাংকের ৮২ শতাংশ শেয়ার যাতে অন্য কোথাও হস্তান্তর করতে না পারে দ্রুত সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা; বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ইসলামী ব্যাংকের সম্পদ লুটপাটের তথ্য অবিলম্বে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র তুলে আনা; বর্তমান দখলদার পরিচালনা পর্ষদ অনতিবিলম্বে বাতিল করে ওই স্থানে পূর্ববর্তী ২০১৩ সালের মতো সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও সক্ষম পেশাদার ব্যক্তিদের নিয়ে একটি নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠনের করা।
গত ২০ আগস্ট সংকটে থাকা বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে ব্যাংকটি পরিচালনার জন্য নতুন পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর নিয়োগের পর এটি এ ধরনের প্রথম পদক্ষেপ।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পর নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে দুটি নামও প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ওই দুজন হলেন— অধ্যাপক আবু আহমেদ ও ইঞ্জিনিয়ার মোস্তফা আনোয়ার।