আসলেই সংকট নাকি কৃত্রিম সংকট তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন
— বলছেন ত্রাণদাতারা
দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ সহায়তা দিতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়েছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। সামর্থ্য অনুযায়ী রাজধানী তথা সারা দেশের মানুষ বন্যার্তদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। রাজধানীতে ‘গণত্রাণ’ সংগ্রহ কর্মসূচিতেও রীতিমতো ত্রাণদাতাদের ঢল দেখা গেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা এবং নগরীর বাসিন্দারা দলবদ্ধ হয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করে ছুটছেন বন্যাদুর্গত এলাকায়। ছোট ছোট শিক্ষার্থীরাও তাদের টিফিনের জমানো টাকা বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় দিতে দেখা গেছে। শুধু তা-ই নয়, পরিধানযোগ্য বস্ত্রও দান করে দিচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। মানবিক বিপর্যয়ের এ সুযোগে স্বৈরাচাররূপে আভির্ভূত হয়েছে অতিমুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। রাজধানীসহ সারা দেশেই পণ্যদ্রব্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে তারা। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তদারকহীনতায় ত্রাণসামগ্রীর বাড়তি দাম আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তারা। রাজধানীর প্রতিটি বাজারেই বেড়ে গেছে ত্রাণসামগ্রীর দাম।
অভিযোগ রয়েছে, মূলত সংকটের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা চিড়া, মুড়ি, গুড়, মোমবাতিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। পুরান ঢাকার মুদি দোকান থেকে শুরু করে চকবাজার, ছোট কাটারা, মৌলভীবাজার, যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজারে এসব জিনিসের দাম বাড়ার নমুনা দেখা গেছে। যদিও ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় জোগান কম থাকায় দাম কিছুটা বেড়েছে।
রাজধানীর মৌলভীবাজার, ছোট কাটারা এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে, বোতলজাত বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ বেশি থাকলেও সেখানকার ব্যবসায়ীরা খালি বোতলের দাম বাড়িয়েছেন আগের তুলনায় ২০ গুণ বেশি। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে পাঁচ লিটার ওজনের খালি পানির বোতলের মুল্য ছিল ১০-১৫ টাকা, সেখানে এখন তারা দাম রাখছেন ৩০ টাকা। দুই লিটার ওজনের বোতলের দাম ছিল ৫-১০ টাকা। এখন তারা রাখছেন ১৫-২০ টাকা। একইভাবে সরেজমিনে রাজধানীর আরও বেশকটি বাজার ঘুরে জানা যায়, বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তা দিতে কদিন ধরেই চিড়া-মুড়ি-গুড়-মোমবাতি কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। শুকনো খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দোকানিরা সংকটের বাহানায় বেশি দামে এসব পণ্য বিক্রি করছেন।
কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি দল বন্যার্তদের সহযোগিতায় শুকনো খাবার কিনতে এসেছিল পুরান ঢাকার পাইকারি মার্কেট মৌলভীবাজারে। তারা বলেন, আমরা প্রায় ৫০০ পরিবারকে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে এখানে শুকনো খাবার কিনতে এসেছি। আগেও আমাদের ক্যাম্পাসের আরেকটি টিম বন্যার্তদের সহায়তা করেছে। তারা যে দামে জিনিসপত্র বিশেষ করে মুড়ি ও চিড়া কিনেছে, এখন একই দোকানি আমাদের কাছে বেশি দাম চাচ্ছে। এই শিক্ষার্থী আরও বলেন, ব্যবসায়ীরা কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে মুড়ি। চিড়ার কেজি প্রায় ২০ টাকা বেশি। আমরা যেহেতু বন্যার্তদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে এসেছি, সেজন্য বাধ্য হয়ে বেশি দাম দিয়েই কিনতে হচ্ছে। চিড়া ও মুড়ি কিনলেও মোমবাতি কিনতে পারিনি। চকবাজার এলাকার সব দোকানেই খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। দোকানিরা বলছেন, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। চিড়া ও মুড়ির চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় এই সংকট দেখা দিয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসেছিলেন বন্যার্তদের জন্য চকবাজার থেকে শুকনো খাবার কিনতে। তারা বলছেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে আলাদা আলাদা করে বানভাসীদের জন্য সহযোগিতা করা হচ্ছে। আবার পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরাও এক হয়ে ত্রাণ দিচ্ছেন। আমি আমার ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে ২০০ মানুষের জন্য শুকনো খাবার কিনতে এসেছি। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র যেমন— মোমবাতি, ওষুধ এবং নারীদের জন্য প্যাড নিয়েছি। রায়হান আহমেদ আরও বলেন, চিড়া ও মুড়ির সঙ্গে সঙ্গে গুড়ের দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। তাছাড়া চকবাজারের কোথাও মোমবাতি খুঁজে পাইনি। এক দোকানি ম্যানেজ করে দিয়েছেন, তবে ১০ টাকার মোমবাতি ১৫ টাকা করে দিতে হয়েছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে অনেক ব্যবসায়ী যেমন বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, তেমনই কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পণ্যের দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা করছেন। ভোক্তা অধিকারের উচিত এ মুহূর্তে ভালোভাবে বাজার তদারকি করা।
বাজারে মোমবাতি সংকটের বিষয়ে চকবাজারের মোমবাতির পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমানে বন্যার কারণে মোমবাতির চাহিদা তিনগুণ বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় মোমবাতি সরবরাহ করতে পারছে না উৎপাদনকারীরা। ফলে আমরাও ক্রেতাদের দিতে পারছি না। আমরা যা পাচ্ছি, তা বেশি দামে কিনে বিক্রি করতে হচ্ছে। কারওয়ান বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা ত্রাণসামগ্রী কিনে ভ্যান ও পিকআপে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল সন্ধ্যা নাগাদ এ দৃশ্য দেখা যায়।
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের নিচতলায় দেখা যায় চিড়া-মুড়ির দোকানে বেশ ভিড়। একটি দোকানে ১০০ কেজি মুড়ি আর ১০০ কেজি চিড়া কিনতে এসেছেন পাঁচ ব্যক্তি। তবে ব্যবসায়ী তাদের জানালেন, তার দোকানে চিড়া-মুড়ি কোনোটাই নেই। সন্ধ্যার পর তাদের যোগাযোগ করতে বললেন তিনি। সেখানে মুড়ি-চিড়া কিনতে আসা শিক্ষার্থীরা বলেন, অগ্রিম টাকা দিয়েও চিড়া-মুড়ি কিনতে পারছি না। গুড়ের জন্য টাকা দিয়েছি দুদিন আগে। আজ (বৃহস্পতিবার) কেবল দোকানদার জানালেন গুড় এসেছে। তাও কেজিপ্রতি ৩০ টাকার ব্যবধান। টাকা থাকলেও সবকিছু একসঙ্গে কিনতে পারিনি। এটা কী আসল অর্থেই সংকট, নাকি কৃত্রিম— তা কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
চকবাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, চিড়া-মুড়ি, গুড়, মোমবাতিসহ প্রায় সবরকম জরুরি পণ্যের সংকট রয়েছে। দামও বেশি। কাস্টমার থেকে অগ্রিম টাকা নিয়েও আমরা সময়মতো এসব পণ্য দিতে পারছি না। কারণ যেরকম চাহিদা, সে পরিমাণে পণ্য পাচ্ছি না। তাছাড়া দামও বেশি দিতে হচ্ছে। বাজারে এসব পণ্যের যে সংকট তৈরি হয়েছে, আশা করি শিগগিরই এই সংকট কেটে যাবে। কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। ফ্যাক্টরিতে এসব মাল নেই বলে তারা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। তারা আরও বলেন, আগে আখের গুড় প্রতি কেজি ১০০-১১০ টাকায় কিনতাম। এখন সেটা ১২০-১২৫ টাকা করে কিনতে হচ্ছে। খোলা চিড়া-মুড়িতেও কেজিপ্রতি পাইকারি ১০-১২ টাকা বেড়েছে; তাও পাওয়া যাচ্ছে না। যা আসছে, তা দোকানে আসার আগেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ওষুধসামগ্রীর মধ্যে নাপা ট্যাবলেটের দাম নিয়েই কেবল কারো কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। প্রতি পাতা নাপা ট্যাবলেট ১১ টাকা করে কিনছেন বলে জানিয়েছেন ক্রেতারা। ত্রাণদাতাদের অনেকেই আমার সংবাদকে বলেন, শুধুমাত্র নাপা ট্যাবলেটের দামই স্থিতিশীল রয়েছে।