ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বৃষ্টিতে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের ১১ জেলায় সৃষ্ট বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। বন্যার পানি কমতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বন্যাকবলিত জেলাগুলো- ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। এর মধ্যে কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় প্রকট আকার ধারন করেছে পানিবাহিত রোগ। চর্মরোগ, ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে পানিবন্দি মানুষ। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও বয়স্করা। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত অনেকে চিকিৎসা নিতে আসছেন মেডিকেল ক্যাম্পে। এ নিয়ে স্বাস্থ্যবিভাগ বলছে, প্রতিটি ইউনিয়নে চিকিৎসাসেবা অব্যাহত আছে। এদিকে ফেনী-কমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলার দুর্গত এলাকায় ত্রাণ না
পৌঁছানোয় বাড়ছে ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বন্যা আক্রান্তরা বলছেন, দীর্ঘদিন পানি আটকে থাকায় বন্যার ময়লা পানিতে চলাফেরা করতে হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি না থাকায় অনেকে বন্যার পানি বিশুদ্ধ করে খাওয়ার চেষ্টা করছেন। চলমান বন্যায় পরিস্থিতি নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য বলছে এখন পর্যন্ত ১১ জেলায় ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ৪১ জন, নারী ছয়জন ও শিশুর সংখ্যা সাত। বন্যায় কুমিল্লায় ১৪ জন, ফেনীতে ১৯ জন, চট্টগ্রামে ছয়জন, খাগড়াছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে আটজন, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় একজন, লক্ষীপুরে একজন, কক্সবাজার তিনজন ও মৌলভীবাজারে একজন মারা গেছেন। তাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে পানিতে ডুবে, সাপের ছবলে ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। মৌলভীবাজারে এখনো একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে জানানো হয় সিলেট, হবিগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলা বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি হয়েছে। ৬৪ উপজেলা বন্যাপ্লাবিত এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ও পৌরসভা ৪৮৬টি। ১১ জেলায় মোট ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৪ হাজার ১৬৭ জন। তিন হাজার ২৬৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখনো চার লাখ ৬৯ হাজার ৬৮৭ জন মানুষ এবং ৩৮ হাজার ১৯২টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। ১১ জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মোট ৫৬৭টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।
ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, সশস্ত্র বাহিনী বন্যাদুর্গত এলাকায় এক লাখ ৯৪ হাজার ২৮৫ প্যাকেট ত্রাণ, ১৯ হাজার ২৬০ প্যাকেট রান্না করা খাবার বিতরণ করেছে। মোট ৪২ হাজার ৭৬৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং ১৮ হাজার ৩৮৯ জনকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ১৫৩ জনকে উদ্ধার করে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীর পরিচালিত মোট ২৪টি ক্যাম্প এবং ১৮টি মেডিকেল টিম বন্যা উপদ্রুত এলাকায় চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। সার্বিকভাবে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরছেন। বন্যাদুর্গত জেলাগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে বলেও জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে নোয়াখালীতে বন্যার পানি ধীরে ধীরে কমতে থাকায় পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে পানিবন্দি থাকায় বিভিন্ন স্থানে বাড়ছে নানা সংকট। বিশেষ করে টিউবওয়েলগুলো ডুবে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আছে রান্না করার খাবারের সংকটও।
এ ছাড়াও বন্যায় চর্মরোগ, ডায়রিয়াসহ নানা পানিবাহিত রোগ বেড়ে গেছে। টানা দুই দিন সূর্যের দেখা পাওয়ায় জনমনে স্বস্তি বিরাজ করছে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ দিলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। যাতায়াত ব্যবস্থা না থাকায় দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। জেলায় বেড়েছে ডায়রিয়া ও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা। লক্ষ্মীপুরেও বন্যা পরিস্থিতি উন্নতির দিকে। তবে এখনো বন্যার ভোগান্তিতে রয়েছে ৫ উপজেলার ১০ লক্ষাধিক মানুষ। ফেনীতে বেশিরভাগ এলাকার পানি নামলেও খাদ্য, সুপেয় পানি ও বিদ্যুৎসংযোগ না থাকায় ভোগান্তিতে আছে তিন লাখ মানুষ। কুমিল্লায় ১৭ উপজেলার মধ্যে ১৪টি উপজেলা বন্যা আক্রান্ত। নৌযান সংকট আর রাস্তাঘাট গভীর পানিতে ডুবে থাকায় দুর্গত অনেক পৌঁছানো যাচ্ছে না ত্রাণ। বাড়ছে ওষুধ ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। বন্যার ভোগান্তি আছে চাঁদপুরের তিন উপজেলা ও মৌলভীবাজারের কাউয়াদিঘি হাওরের গ্রামগুলোতেও। এদিকে বৃষ্টিপাত কমে দেশের প্রধান প্রধান নদনদীর পানি সমতল বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণকেন্দ্র। কেন্দ্রের গতকালের বুলেটিনে বলা হয়েছে, গতকাল দেশের উজানে উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত কেবল মুন্সীগঞ্জের ভাগ্যকূল স্টেশনে ৫৪ মিলিমিটার নথিবদ্ধ করা হয়েছে।
এ ছাড়া এই সময়ে অন্য কোথাও উল্লেখযোগ্য বৃষ্টিপাত নেই। কেন্দ্র বলছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদনদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় থাকতে পারে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের মনু নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যান্য প্রধান নদীগুলোর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণকেন্দ্র বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা নেই। ফলে এ সময় এ অঞ্চলের মনু, খোয়াই, ফেনী, মুহুরী, গোমতী, তিতাস ইত্যাদি নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে এবং বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস নেই। এ সময় এ অঞ্চলের সাঙ্গু, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, হালদা ও অন্যান্য প্রধান নদীসমূহের পানি সমতল হ্রাস পেতে পারে।
আরএস