মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে উপপরিচালক পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। যদিও দপ্তরটিতে ৭২টি উপপরিচালক পদের মধ্যে ৬২টি পদই শূন্য। একটি দপ্তর এ অবস্থায় কীভাবে চলছে— এ প্রসঙ্গে জানা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি প্রদান বন্ধ রাখা হয়েছে সেখানে। নিয়োগপ্রাপ্ত উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের কর্মস্থল উপজেলায় হলেও ৫০টিরও বেশি উপজেলার পদ শূন্য করে রাজনৈতিক প্রভাবে সদর কার্যালয়, ঢাকায় দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছেন তারা। তাদের প্রত্যেকেই স্বৈরাচার সরকারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী
ফরহাদ হোসেনের ঘনিষ্ঠ তারা। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সাবেক ওই মন্ত্রীর রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতারই শিকার হয়েছেন মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের অন্যসব মেধাবী কর্মকর্তা। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় প্রথমদিকে থেকেও যাদের ভাগ্যে জোটেনি অদ্যাবধি পদোন্নতি। জুনিয়র কর্মকর্তাদের দিয়েই জোড়াতালির মাধ্যমে এখনো চলছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রম।
অধিদপ্তর সূত্র জানায়, গত আট বছর ধরে পদোন্নতির জন্য অনুমোদিত জ্যেষ্ঠতার তালিকা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অথচ অধিদপ্তর থেকে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করে প্রস্তাবনা পাঠালেও রাজনৈতিক চাপে সেটি ঝুলিয়ে রাখে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সরাসরি বাধা দিয়েছেন এতে। কারণ, মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে তিনি একটি রাজনৈতিক বলয় গড়ে তুলেছিলেন। এই বলয়ের আওতায় থাকা স্বৈরাচার সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট দলীয় কর্মকর্তারা জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে জুনিয়র হলেও অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে বসে আছেন গুরুত্বপূর্ণ শাখার সিনিয়র পদগুলোতে। জুনিয়র হলেও অতিরিক্ত দায়িত্বের কথা বলে তাদের দিয়েই চলছে অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ শাখার কার্যক্রম। এ বিষয়ে বারবার বলা হলেও কর্ণপাতই করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
অনুমোদিত জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ৮১ নম্বরে থাকা শিশু দিবাযত্ন শাখার সহকারী পরিচালক কানিজ তাজিয়া, যার মূল পদ উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা; অথচ তিনি দায়িত্ব পালন করছেন উপপরিচালক ডে-কেয়ার হিসেবে। তার স্বামী সাবেক স্বৈরাচার সরকারের তৎকালীন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ এবং একটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেও জানা গেছে। জ্যেষ্ঠতার তালিকায় ৪৮ নম্বরে থাকা রেজিনা আরজু লাভলী প্রশিক্ষণ শাখার উপপরিচালক পদে চলতি দায়িত্বে রয়েছেন। তার ভাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব, বর্তমানে বাংলাদেশ কর্মকমিশনের (পিএসসি) সদস্য। এসব ক্ষমতার অপব্যবহার করেই মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
এদিকে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার শূন্যপদগুলোর দায়িত্বও পালন করছেন অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ওইসব কর্মকর্তা। একজন কর্মকর্তার ওপর তিন থেকে চারটি উপজেলার দায়িত্ব দেয়ায় সেবাগ্রহীতারাও পাচ্ছেন না তাদের কাঙ্ক্ষিত সেবা। দীর্ঘদিন ধরেই এমন অবস্থা চলছে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে। এ নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কেউই মাথা ঘামাচ্ছেন না বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর সূত্র।
শুধু তা-ই নয়, মাঠ পর্যায়ের উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের অন্তত ৬০ থেকে ৭০ জন এখনো অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদে রয়েছেন। এতে মাঠ পর্যায়ে অধিদপ্তরটির সার্বিক কার্যক্রমে অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। যারা পদোন্নতির যোগ্য, তাদের করা হয়েছে বঞ্চিত। বিষয়টি সুবিবেচনার জন্য অধিদপ্তরের সাবেক ও বর্তমান মহাপরিচালক অনুমোদিত জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুযায়ী পদোন্নতি প্রদানের জন্য মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে বারবার চিঠিও দেয়া হয়েছে। এরপরও তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়নি। উল্টো সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন তার রাজনৈতিক দোসরদের অনৈতিক সুবিধা দিতেই বন্ধ রেখেছিলেন পদোন্নতি। এছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের দিয়ে জ্যেষ্ঠতার তালিকার বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। যে মামলা খারিজ করে দেন আদালত। কিন্তু জনপ্রশাসন ও আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইং থেকে পদোন্নতি প্রদানে কোনো বাধা নেই বলে জানানো হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এসব সুপারিশেও কর্ণপাত করেননি।
অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, যারা পদোন্নতি প্রদানে বাধা দিচ্ছেন, তারা উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা। কোনো কারণ না থাকা সত্ত্বেও তারা একের পর এক মামলা, আপিল ইত্যাদি দিয়ে অকারণে কালক্ষেপণ করছেন। এতে তাদের বড় সুবিধা হলো— তারা পদোন্নতির যোগ্য না হয়েও বিগত সরকারের ছত্রছায়ায় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয় বসতে পেরেছেন। এরা সবাই মাঠ পর্যায়ের উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা। এরা এতটাই অবৈধ সুবিধাভোগী যে, তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা হিসাবে। কিন্তু ঢাকায় এসেছেন সহকারী পরিচালকসহ আরও অন্যান্য সুবিধাজনক পদের বিপরীতে। অতঃপর উপপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে আসীন রয়েছেন। অথচ যারা দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতির যোগ্য, তাদের পদোন্নতি না দিয়ে চরম বৈষম্যের সৃষ্টি করা হচ্ছে। পদোন্নতিবঞ্চিতরা বলছেন, সম্প্রতি যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঘটেছে দেশে, তার সুফল রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরেই পৌঁছানো প্রয়োজন।
জানতে চাইলে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমা মোবারেক গতকাল বুধবার আমার সংবাদকে বলেন, ‘এটা আমরা অনুমোদন করেছি। এখন প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে মামলা চলছে। দু’পক্ষই করেছে। ট্রাইব্যুনাল থেকে সিদ্ধান্ত এলেই আমরা এটা (পদোন্নতি) দিয়ে দেব। আমরা এটার (প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত) জন্যই শুধু অপেক্ষা করছি এখন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তাদের (প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল) তাড়াতাড়ি করার জন্যও বলেছি। এ বিষয়ে ফোন দিয়েও খোঁজ নিচ্ছি আমরা। এক্ষেত্রে আমরা কোনো সমস্যা দেখছি না। শুধু সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।’
যদিও পদোন্নতিবঞ্চিতরা বলছেন, পদোন্নতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার উদ্দেশ্যেই যেহেতু জুনিয়র কর্মকর্তাদের (উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা) সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা চলছে, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষকেই অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের সার্বিক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে দ্রুত বিষয়টির সমাধান করে জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুযায়ী যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে হবে। অন্যথায় অধিদপ্তরের সার্বিক কার্যক্রমে যেমন অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে, তেমনি কর্মকর্তাদের মধ্যেও চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ারও আশঙ্কা রয়েছে।