দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট ও পাচারের মূল হোতা এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দে রহস্যজনক আচরণ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হারানোর পর আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারিতে জড়িত বিভিন্ন ব্যক্তি গা-ঢাকা দেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেয়ার পর পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে হার্ডলাইনে যান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর। ঘোষণা দিয়ে একে একে লুটপাট ও অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজনদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে মানিলন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত বিএফআইইউ। এ তালিকায় সাবেক সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা ও মন্ত্রীরাও রয়েছেন।
তবে রহস্যজনক কারণে বহুল আলোচিত-সমালোচিত এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার সাত ভাইয়ের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তাদের কোনো ব্যাংক হিসাব এখনো পর্যন্ত জব্দের ঘোষণা দেয়া হয়নি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। শুধু তিনিই নন, তার পরিবারের সদস্যদেরও ব্যাংক হিসাব জব্দ করেনি সংস্থাটি। প্রশ্নে উঠেছে, তাহলে কী এস আলম ও রউফ তালুকদার সিন্ডিকেটের গোপন হাতের ইশারায় এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছেন তারা! কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, এস আলমের কাছ থেকে নিয়মিত উপরি নিতেন— কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন অর্ধডজন কর্মকর্তা এখনো নিজ পদে বহাল আছেন। যাদের মধ্যে একজন ক্ষমতাধর নির্বাহী পরিচালকও রয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএফআইইউর এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, এস আলম বা সাইফুল আলম মাসুদের ব্যক্তিগত কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আমরা এখনো পাইনি। এমনকি তার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে সার্চ করেও (এস আলমের) ওই নামে কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পাওয়া যায়নি। এস আলমের পরিবারের সদস্যরা কেউ বাংলাদেশের নাগরিকই নন। তাছাড়া তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাংকের অ্যাকাউন্টও পাওয়া যায়নি। এস আলম-সংশ্লিষ্টদের কোনো ব্যাংক হিসাবের হদিস পাওয়া গেলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। যদিও দীর্ঘদিন এস আলম গ্রুপের কর্তৃত্বে ছিলো বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংক। আইন লঙ্ঘন করে এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে ছিলেন এস আলম পরিবারের একাধিক সদস্য। তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা নামে-বেনামে, অবৈধ উপায়ে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন। যার প্রকৃত হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংক থেকেই তুলে নিয়েছেন ৭৫ হাজার কোটি টাকা।
এস আলমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ার কারণ সম্পর্কে বিএফআইইউর ওই কর্মকর্তা আরও জানান, আমরা তথ্য আহরণের চেষ্টা করছি; শনাক্ত করতে পারলে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের অ্যাকাউন্টগুলো আমরা ধরব। এখন এগুলো ধরলে দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। তারা চাল, ডাল, আটা, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য আমদানি করে থাকে। ব্যক্তির জন্য যাতে প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মীর ওপর চাপ তৈরি না হয়, সেদিকে আমরা খেয়াল রাখছি। অন্যান্য ব্যবসায়ীর মতো এস আলম ব্যাংকে বেশি টাকা রাখতেন না। তিনি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন এবং শেয়ারের মালিকও ছিলেন; কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব হলো— জানতে চাইলে বিএফআইইউর এই কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংক পরিচালক হতে হলে ওই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে এমনটি নয়। বেনামি হিসাব থেকে এস আলম সে টাকা তুলে নিচ্ছে। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে আমরা ওই ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য চেয়েছি। বিস্তারিত তথ্য পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে যখন এস আলমের ব্যাপারে কোনো তথ্য চাওয়া হয়েছে, তখন তৎকালীন গভর্নর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে যা আছে, তা দিয়ে দিন। এখন আমাদের ওপর আগের মতো কোনো চাপ নেই। আমরা ভালো আছি; তাই নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছি।
এস আলমের ব্যাংক হিসাব জব্দের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমরা কোনো প্রতিষ্ঠান নয়; বরং ব্যাংকের টাকা লুটপাটকারী ব্যক্তিকে টার্গেট করে কাজ করছি। পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা বলেছি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দুবাই ও সিঙ্গাপুরে বেশি টাকা পাচার করা হয়েছে, সেসব টাকা উদ্ধারে ওইসব দেশের সঙ্গে ইতোমধ্যে আলোচনা করেছি।