ইউনূসের পর ‘মিরাকেল’ সরকার

আবদুর রহিম প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৪, ০২:৫৪ পিএম

পালিয়ে গেছেন স্বৈরাচার হাসিনা। শত শত ছাত্র-জনতার রক্তস্রোত ও অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আসে নতুন বিজয়। জনগণের চাওয়ায় গত ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই থেকে এক মাস পার হলো সম্প্রতি। এখনো কিন্তু ঠিক হয়নি ড. ইউনূস কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন। সরকারে থাকা নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, যে কারণে অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই কারণগুলো সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র-জনতার সরকার দেশের নেতৃত্বে থাকবে। এ জন্য কমপক্ষে তিন বছর লাগবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। ২০২৭-এর শেষদিকে জাতীয় নির্বাচনের গুঞ্জন রয়েছে। এরই মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, ড. ইউনূসের পর কে ক্ষমতায় আসবে? বিএনপি-জামায়াত, নাকি অন্য কেউ। অন্তর্বর্তী সরকারের বিশ্বস্ত সূত্রগুলো ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কোন দল নির্দিষ্টভাবে ক্ষমতায় আসবে— তা এখনো ধারণা করা মুশকিল। কারণ হাসিনার পতন কোনো রাজনৈতিক দলের আন্দোলনে হয়নি। ছাত্র, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। হাসিনার বিদায়টা যেমন ‘মিরাকেল’ আকারে হয়েছে, যা কয়েক ঘণ্টা আগেও ধারণা করা যায়নি; ঠিক তেমনই ড. ইউনূসের পর কোন দল বা কারা ক্ষমতায় আসবে, তাও ধারণার বাইরে থাকবে। মিরাকেল আকারেই কিছু হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।  

রাজনীতিতে দৃষ্টি রাখা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হাসিনার পতনের পরপরই দেশে বহু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, চুরি-ডাকাতিসহ বহু ঘটনার জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। প্রতিবিপ্লবেরও চেষ্টা হয়েছিল কয়েকবার। ৩-৪ দিন সরকার ছাড়াই দেশ চলেছে সুশৃঙ্খলভাবে। তখন ছাত্র-জনতা মাঠে থেকে সবকিছুই রুখে দিয়েছে। বিপ্লব ঘটানো ছাত্রনেতৃত্বের ওপর মানুষের বিশ্বাস বেড়েছে আকাশচুম্বি। ভোটাধিকার নি্লিত হলে জনগণ এখন একটি ভোট দিতে বহুবার চিন্তা করবে। স্বৈরাচার হাসিনার রূপ এখন আর কেউ দেখতে চাইবে না। অনেকে মনে করছেন, ড. ইউনূস যে কদিন ক্ষমতায় থাকবেন, ততদিন চলবে বিএনপি-জামায়াতের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। হাসিনা দেশ ছাড়ার পর রাজনৈতিক পূর্ণশক্তি নিয়ে মাঠে নেমছে এই দুটি দল। অধিক স্বাধীনতায় তারা যদি রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার বা কোনো ভুল করে, তাহলে তারা জনবিচ্ছিন্ন হতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। 

ইতোমধ্যে ভোটের মাঠে বিভিন্ন ধরনের সমীকরণ তৈরি হয়েছে। একসময়কার বিএনপি-জামায়াতে দূরত্ব তৈরি হয়েছে ভোট প্রসঙ্গ নিয়ে। জাতির উদ্দেশে দেয়া ড. ইউনুসের ভাষণে নির্বাচনের রূপরেখা না থাকায় একটি দল ক্ষোভও প্রকাশ করেছে। তারা দ্রুত নির্বাচন চেয়েছে। অন্যদিকে ইউনূস সরকারকে স্বাগত জানিয়ে সংস্কারের জন্য সময়ের কথা বলেছে জামায়াত। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পার হওয়ার পর মাঠে অনেকগুলো দৃশ্য উপস্থাপন হচ্ছে। ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে গঠন হচ্ছে বৃহৎ ইসলামি জোট। দলগুলোর সঙ্গে ইতিপূর্বেকার মতবিরোধের দূরত্ব কেটে যাচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন ঝুলে থাকা নাগরিক ঐক্য, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ নিবন্ধন ফিরে পেয়েছে। আদালতের মাধ্যমে নিষিদ্ধ জামায়াতও সিদ্ধ হলো। বন্যা ইস্যুতে মানুষের সহানুভূতি পেতে পূর্ণশক্তি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে বিএনপি। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, ছাত্রদল, যুবদল সবাই নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে ত্রাণ কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছে। একই কাজ করছে জামায়াতও। সব দলই ভোটারদের কাছে টানতে ইস্যু নিয়ে চাঙ্গা রাজনীতি করে যাচ্ছে।  

তবে এত সক্রিয়তার মধ্যেও বেলা শেষে ভোটের সমীকরণে মিরাকেল কিছুই আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রাজনীতির ‘রহস্য পুরুষ’ মৃত সিরাজুল আলম খানের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি জ্যেষ্ঠ এক রাজনীতিবিদ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে আমার সংবাদকে বলেন, সরকার পতনের এক দিন আগেও যদি আমাকে কেউ জি”েস করত কাকে ভোট দেবেন, কে ক্ষমতায় আসবে। আমি নির্দ্বিধায় বলে দিতাম বিএনপি-জামায়াত নির্যাতিত দল, তারাই আগামীতে ক্ষমতায় আসতে পারে। কিন্তু এখন তো তারা আর নির্যাতনের মধ্যে নেই। তাদের আচরণগুলো দিনে দিনে দৃশ্যায়িত হচ্ছে আর জনগণ সেগুলো অবশ্যই ভোটের সময় হিসাব করবে। 

অন্যদিকে আমরা দেখছি ছাত্ররা এখনো মাঠে রয়েছে। তারা সারা দেশে ভ্রমণ করছে জনগণের অধিকার নি্লিতে। যদিও তারা এখনো ঘোষণা দেয়নি রাজনৈতিক দল গঠন করবে কি-না। তারা যদি শেষ সময়ে এসে রাজনৈতিক দল গঠন করে, তবে মিরাকেল কিছু ঘটবে বলে অনুমান করছি। 

ভোটের দিনক্ষণ-সময় নিয়ে বিশ্বস্ত একটি সূত্র বলছে, নির্বাচন আয়োজনের আগে পুলিশ বাহিনীকে নতুন করে সাজানো, নির্বাচন কমিশন নতুন করে গঠন করা, জুডিশিয়ারিতে পরিবর্তন আনার মতো কতগুলো বুনিয়াদি সমস্যার সমাধান অতীব জরুরি। এগুলো সংস্কার ব্যতীত একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে না। এজন্য ড. ইউনূস সরকার রাষ্ট্রের চারটি গুরুত্বপূর্ণ খাত নির্বাচন ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা, জনপ্রশাসন ও বিচার বিভাগে সংস্কারের মতো বিষয়গুলোতে বেশি মনোযোগী হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ এই খাতগুলো স্বৈরাচার হাসিনা সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতসহ ডান-বাম সব রাজনৈতিক দলই এই খাতগুলো সংস্কারে পরামর্শ দিয়েছে। 

বিশ্বস্ত সূত্রটি বলছে, চলতি মাসের মধ্যেই নির্বাচনি রোডম্যাপ তৈরি হচ্ছে। সংবিধান পুনর্গঠনের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হবে। ওই কমিটি ঠিক করবে নির্বাচনের সম্ভাব্য তারিখ। সেই কমিটি ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়টি সংবিধানে যুক্ত করবে। ধারণা করা হচ্ছে, ড. ইউনূস সরকারের মেয়াদ তিন বছর হতে পারে। কোনো রাজনৈতিক দলের চিফ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না— এ বিষয়গুলো যুক্ত থাকাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। একজন প্রধানমন্ত্রী টানা কতবার ক্ষমতায় থাকবেন— এ বিষয়টিও যুক্ত হচ্ছে বলে সূত্রটির ভাষ্য।  

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. দিলারা চৌধুরী আমার সংবাদকে বলেন, দেশটাকে নতুন করে সাজানোর একটা সময় এসেছে। আপনারা দেখেছেন হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর ৪-৫ দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। সরকার ছাড়াই দেশ চলেছে। তখন কিন্তু কোনো চুরি-ডাকাতি, খুনখারাবি হয়নি। মানুষের মধ্যে একটা দায়িত্ববোধ এসেছে। সচেতনতা এসেছে। অভ্যুত্থানের পর জনগণের চাওয়ায় একটা উপদেষ্টা সরকার এসেছে। যে কারণে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে, সেই কারণগুলো এখন সংস্কার করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, শিক্ষা এ বিষয়গুলো খুব শিগগির ঠিক হলে একটা নির্বাচন হবে। তবে নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই স্বচ্ছতার পরিচয় দিতে হবে। দখলদারিত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। না হলে জনগণ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। যদিও আমরা দেখছি বিএনপির কিছু নেতাকর্মী কিছু দখলের কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। বিএনপি মহাসচিব তাদের কঠোর হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, কাউকে কাউকে বহিষ্কারও করা হচ্ছে। তাই দেশবাসী আশা করছে সবাই সংশোধন হবে। যদি কেউ ভুলে হাসিনার পথে পা বাড়ায়, তাহলে জনগণ অবশ্যই তাদের গ্রহণে আগামীতে সাবধানতা অবলম্বন করবে। জনগণ এখন অনেক সচেতন হয়েছে। ধারণা করছি, খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে জনগণ ড. ইউনূস সরকারের পর নতুন সরকার বেছে নেবে।   

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তরিকুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত কোনো ভালো অর্জন হয়নি। বাংলাদেশের যত রাষ্ট্রীয় কাঠামো রয়েছে, তা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে ধ্বংস হয়ে গেছে।  আমরা বছর থেকে বছর পর্যন্ত দেখছি সবকিছু দলীয়করণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে মানুষ ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এবার লাখো ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার হাসিনার পতন হয়েছে। হাসিনা তার যে ভয়ঙ্কর রূপ বাংলাদেশে দেখিয়ে গেছে, আগামীতে তা আর কেউ দেখাতে পারবে না। অভ্যুত্থানের পর এখন দেশে সংস্কার চলছে। যে কারণে অভ্যুত্থান হয়েছে, সেই কারণগুলো ঠিক করা হচ্ছে। এরপর যে সরকার আসবে, দেশের সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত পদগুলো যেন আইন ও নীতির মাধ্যমে চলতে পারে— তা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ড. ইউনূসের পর যে সরকার আসবে, সেখানে মানুষ যেন পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে তাদের অধিকার নি্লিত করতে পারে, সে লক্ষ্যেই কাজ করা হচ্ছে। জনগণের অধিকার নি্লিত করাই থাকবে পরবর্তী সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য— আমরা তা-ই মনে করছি। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাজমুল ইসলাম বলেন, সংস্কার-পরবর্তী আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই, যাতে প্রত্যেকে মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী থেকে সরকারের সব এমপি-মন্ত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারী জবাবদিহির মধ্যে থাকবেন। হাসিনার মতো নির্লজ্জ কোনো ব্যক্তি আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না। হাসিনার পিয়নের মতো কেউ আর ৪০০ কোটি টাকার মালিক হতে পারবে না। প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত মানুষের অধিকার নি্লিত করা হবে। শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মানের হবে। চলমান সংস্কারের পর এমন একটি বন্দোবস্ত নি্লিত হবে, সেখানে মানুষ ভোটাধিকার নি্লিত করতে পারবে। ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নি্লিত হবেন। রক্ষক কিন্তু ভক্ষক হবেন না— এমন ব্যক্তিরাই আগামীতে বাংলাদেশে নেতৃত্ব দেবেন।