শত সংকটেও আস্থা এ সরকারে
ছাত্র-জনতার রক্তস্রোতের বিজয়ের পর বিপ্লব সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিশ্বমঞ্চে এক নতুন বাংলাদেশ উপস্থাপন করেছেন তিনি। এমন প্রেক্ষাপটেও বহুমুখী চাপের মধ্যে রয়েছে ইউনূস সরকার। বিশেষ করে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো শুরুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সাহায্যের কথা জানালেও সম্প্রতি দলগুলো নির্বাচনের রোডম্যাপের জন্য নানাভাবে চাপ তৈরি করছে। প্রকাশ্যে সভা-সেমিনারে নির্বাচন দিতে বক্তব্য দিচ্ছে। অন্যদিকে হাসিনা সরকারের ধ্বংস ও নৈরাজ্যের মধ্যে রেখে যাওয়া বিচার বিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানসহ অন্য সব সেক্টরে কাজ করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বিশেষ করে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনে যারা রয়েছেন, তারা গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের দোসর বলেই ড. ইউনূস সরকারের সূত্রগুলো বলছে। বৃহৎ এই প্রশাসনের জনবল দিয়ে কোনোভাবেই ছাত্র-জনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এর মধ্যে মাঠ পর্যায় থেকে দাবি এসেছে— পুলিশে সংস্কার ব্যতীত জনগণ পুলিশকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে রাজি নয়। বিগত ১৫ বছরে পুলিশ ও র?্যাব শত-সহস্র খুনের সঙ্গে জড়িত। সীমান্তে চোরাকারবারির সঙ্গে জড়িত বিজিবি। আর সচিবায়লয়কেন্দ্রিক হাসিনার অনুসারীরা যে কোনো সময় ক্যু করতে পারেন— এমন আশঙ্কা সরকারের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও দাবি উঠে আসছে। ভারতে পালানোর আগে হাসিনা সরকার দেশি ব্যাংক ব্যবস্থা ও বিদেশি সূত্রগুলো থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ করে দেশকে ঋণ-দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ভগ্নদশা অবস্থায় নেতৃত্ব দিতে হচ্ছে।
রাজনীতি-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস হিমালয়সম সমস্যার মুখোমুখি হয়ে আছেন। যদিও অল্প সময়ে তিনি বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। বিশ্বনেতাদের কাছে রক্তস্রোতের ইতিহাস পৌঁছে দিয়েছেন। সারা দুনিয়াও এখন ড. ইউনূসের কারণে বাংলাদেশকে গুরুত্বের সঙ্গে নজরে রেখেছে। দেশের জনগণ চাচ্ছে একজন গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত মানুষের মাধ্যমে সংস্কারকাজ সম্পন্ন হোক। তাই ড. ইউনূসও তার নেতৃত্ব এবং সময়কাল দেশের জনগণের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। তার সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের জনগণ যখন চাইবে, তখনই নির্বাচন হবে এবং তিনিও বলেছেন, নির্বাচন বিষয়ে তার সরকারের পক্ষ থেকে যখন ঘোষণা আসবে— সেটাই হবে চূড়ান্ত ঘোষণা। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই অন্তর্বর্তী সরকার দেশে নির্বাচন আয়োজন করবে। ‘নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী এবং গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয় সংস্কার করেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
ইউনূস সরকারে চোখ রাখা অভিজ্ঞরা বলছেন, সাফল্য বাস্তবায়নে প্রতিটি সেক্টরে প্রয়োজন দক্ষদের পদায়ন। যাদের নেতৃত্বে একটি স্বপ্নের বাংলাদেশ বা সোনার বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথে এগোবে; দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে। অভিজ্ঞরা বলছেন, একসঙ্গে আওয়ামী অনুসারী প্রশাসনের সঙ্গে লড়াই করা কষ্ট হচ্ছে। আবার সবাইকে বাদ দিয়ে কাঠামো ঠিক রাখাও দুষ্কর। তবুও যারা দেশকে ভালোবাসেন— এমন যোগ্যদের খুঁজে বের করা হবে, যাদের গত ১৫ বছরে দুর্নীতি-নৈরাজ্য কম।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, গত ১৫ বছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি যেভাবে দেশকে কলুষিত করেছেন, সে অবস্থা থেকে ফেরাতে কিছুটা সময় লাগবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব নিয়েছেন খুবই অল্প সময় হলো। কিছু কিছু স্থানে বিশেষ করে অর্থ উপদেষ্টা, শিক্ষা ও জ্বালানি, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ কিছু পদায়ন ভালো হয়েছে। অল্প সময়ে পুরো আগের বলয় ভাঙা কঠিন বা শূন্যপদে সঠিক ব্যক্তিকে বসানো কঠিন। তবে আমি আশাবাদী, কিছু ভুলত্রুটি শুধরে বর্তমান নেতৃত্বে সঠিক পথে এগোবে বাংলাদেশ।
সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মাসুদ কামাল বলেছেন, শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন টিকিয়ে রাখতে তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে পুলিশ বাহিনী বা র্যাবই। এই বাহিনীগুলোতে গত ১৫ বছরে যারাই ঢুকেছে, তাদের একটা কঠিন ছাকনির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। পরিবারের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে এমনভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে, যেন এই দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য পরিবারের এসব বাহিনীতে প্রবেশের কোনো অধিকারই নেই। সেসব চিহ্নিত দলীয় সন্তানরা কিন্তু এই ১৫ বছরে অনেক দূর শিকড় বিস্তার করে ফেলেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সরকারকে সেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ করা ব্যক্তিদের ওপরই নির্ভর করতে হবে। একই কথা বলা যায় আমলাতন্ত্র নিয়েও। এই যে এত বড় একটা আন্দোলন হয়ে গেলো ছাত্র-জনতার, এদের পক্ষে কিছুমাত্র সহযোগিতা কী করেছে কোনো আমলা? করেনি। অথচ তারাই এখনো নিয়ন্ত্রণ করছে সব প্রশাসন। এ কথা কিন্তু মানতেই হবে, স্বৈরতন্ত্রের আমলা ও প্রশাসন দিয়ে কখনো একটা বিপ্লবী সরকার চলতে পারে না। পুলিশ আর আমলাবিষয়ক এই যে বাস্তবতা, আমার ধারণা এগুলো ভোগাবে এই সরকারকে।
নির্বাচন প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, রাজনৈতিক দলসহ সব পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে সংস্কার ও নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরি করে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিয়ে সম্মানের সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিদায় নিতে হবে। কেননা, বছরের পর বছর দেরি করলে আগাছা জন্ম নিতে পারে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এবং তৃতীয় শক্তির উদ্ভব হতে পারে। যদিও সূচনালগ্নে তিনি বলেছিলেন এই সরকারকে সংস্কার পর্যন্ত তার দল যৌক্তিক সময় দেবে।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন নিয়ে আসা বিভিন্ন মন্তব্যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। বিপ্লব এবং সংস্কারের মূলমন্ত্রই হচ্ছে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন। আর সেটার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন নিয়ে রহস্য সৃষ্টি করছে। সরকারের তরফ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে আসা নানা মন্তব্যে জনমনে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব গতকাল আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নির্বাচন কবে হবে— সেটা ঠিক করবে দেশের জনগণ। আমাদের প্রশ্ন, জনগণকে কী তাহলে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য আবার রাজপথে নামতে হবে? একমাত্র নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই জনগণের রায় জানা যাবে।
ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের দোসর অনেক সচিবসহ কর্মকর্তারা এখনও বিভিন্নভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে নাশকতা করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, প্রশাসনের মধ্যে যদি এমন লোক থাকে, যারা শেখ হাসিনার ১৫-১৬ বছর ক্ষমতা থাকাকালীন ফ্যাসিবাদ লুণ্ঠনে সহায়তা করেছে, তারা একটি বিপ্লবের সরকারকে কখনোই সমর্থন দিতে পারে না। তারা যদি ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হয়, সচিব হয়, গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে বসে, তাহলে নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, সেই সংস্কার বাস্তবায়ন হবে না। এরা সংস্কার ব্যর্থ করে দেবে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সাঙ্গপাঙ্গ-সুবিধাবাদীরা এখনো বিদায় নেয়নি, প্রশাসনের অনেক জায়গায় তারা আছে। অনেক সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা শেখ হাসিনার জন্য কাজ করেছে, তারা এখনো আছে। তারা বিভিন্নভাবে ঝামেলা ও নাশকতা করার চেষ্টা করছে। তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ এক নিবন্ধে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাজের ধীরগতি নিয়ে বলেছেন, তার কাজে ধীরগতি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে বটে; কিন্তু যেরকম জটিল পরিস্থিতিতে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, তাতে ধীরগতি অস্বাভাবিক কিছু নয়। জনগণের আশা, তার সরকার আরও দৃঢ়তা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবে। তিনি বলেন, প্রধান উদ্দেশ্য দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রকাঠামোয় সংস্কার সাধন।