ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ ঘাটতি

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক প্রকাশিত: অক্টোবর ১৩, ২০২৪, ১১:৪৫ পিএম

ফের আইএমএফের ঋণ চায় বাংলাদেশ

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। প্রবাসী আয় বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তিন মাস চলার মতো যে পরিমাণ রিজার্ভ থাকা দরকার, সেই নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ) এখনো ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়েছে। সংকট কাটাতে আইএমএফের কাছে আরও ঋণ চেয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের সবশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, অর্থ পাচার প্রবণতা কমে আসায় এখন খোলাবাজারের সঙ্গে ব্যাংকের ডলার দরে পার্থক্য কমেছে। ফলে ডলারের দর স্থিতিশীল হয়ে এসেছে। এতে করে রেমিট্যান্স দ্রুত বাড়ছে। চলতি অক্টোবরের ৮ তারিখ পর্যন্ত গ্রস (মোট) রিজার্ভ দুই হাজার ৪৯৭ কোটি মার্কিন ডলার বা ২৪ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ এখন এক হাজার ৯৮২ কোটি ডলার (১৯ দশমিক ৮২ বিলিয়ন)। গত সপ্তাহে অর্থাৎ ২ অক্টোবর গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন এবং বিপিএম-৬ ছিল ১৯ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসেবে রিজার্ভ সামান্য বেড়েছে। তবে এর বাইরে গ্রস রিজার্ভ ও বিপিএম-৬ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়।

চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেট ইন্টারন্যাশনাল রিজার্ভ (এনআইআর) বা ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ আছে এক হাজার ৪৭১ কোটি মার্কিন ডলার (১৪ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলার)। প্রতি মাসে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে না। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়। একটি দেশের অর্থনীতির অন্যতম সূচক হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বরের জন্য বেঁধে দেয়া ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ৪৮৮ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে চলমান সংকট কাটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু চাহিদা ঠিক রাখতে গিয়ে প্রতিশ্রুতি উপেক্ষা করে সেপ্টেম্বরেও রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তবে এখন রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অনেকটা বন্ধ আছে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘বৈশ্বিক আর্থিক সংকটে আমাদের সমস্যা হয়নি, আমরা ভাগ্যবান। চার-পাঁচটি পরিবার ব্যাংক থেকে দুই লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। এতে অর্থনীতিতে মন্দা নেমে আসতে পারত, সেটা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করলে ছয় মাস পর শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হয়ে যেত। রিজার্ভ থেকে আগের মতো ডলার বিক্রি করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক এটা কোনো সমাধান হতে পারে না। এজন্য আমাদের কিছুদিন কষ্ট করতে হবে।’

২০২৩-২৪ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে এক হাজার ২৭৯ কোটি মার্কিন ডলার বিক্রি করেছিল। তারও আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিক্রি করে এক হাজার ৩৫৮ কোটি ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি করে ৭৬২ কোটি মার্কিন ডলার।

২০২১ সালে কোভিড-১৯-এর সময় রিজার্ভ বাড়লেও তখন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নজিরবিহীন অর্থপাচার, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে পড়ে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় (রিজার্ভ)। বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে তখন ক্রমাগত চলতি হিসাবের ঘাটতিও বেড়েছিল বাংলাদেশের। ২০২২ সালের জুলাইতে ডলারের বিপরীতে টাকার দর অবনমন হতে থাকলে প্রভাব পড়ে জ্বালানির দর ও আমদানিতে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তখন আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চেয়ে আবেদন করে বাংলাদেশ। দীর্ঘ আলোচনার পর নভেম্বরে ঋণচুক্তি অনুমোদন দেয় আইএমএফ। পরে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি কিছু শর্তে আইএমএফের সঙ্গে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। এর তিন দিন পর প্রথম কিস্তিতে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ৭০ হাজার ডলার ছাড় করে সংস্থাটি। এরপর গত ১৬ ডিসেম্বর দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার এবং জুনে তৃতীয় কিস্তির ১ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড় করা হয়। সব মিলিয়ে তিন কিস্তিতে প্রায় দুই দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ।

চুক্তি অনুযায়ী, আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত কিস্তিতে ঋণের পুরো অর্থ ছাড় করার কথা রয়েছে। ঋণচুক্তির চতুর্থ কিস্তি ছাড় হওয়ার কথা চলতি বছরের ডিসেম্বরে। বাংলাদেশকে দেয়া ঋণের অন্যতম শর্ত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ সংরক্ষণ রাখতে হবে। সে হিসেবে আইএমএফের পক্ষ থেকে সেপ্টেম্বরের জন্য বেঁধে দেয়া ব্যয়যোগ্য রিজার্ভের লক্ষ্য ১৪ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার বা এক হাজার ৪৮৮ কোটি মার্কিন ডলার; কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি বাংলাদেশ।

এদিকে ব্যাংক খাত সংস্কার, অর্থপাচার প্রতিরোধে, কর ব্যবস্থাপনা, আয়কর ও ভ্যাট সংস্কারে নতুন করে আরও তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা চেয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বাংলাদেশকে নতুন করে ঋণ দেয়ার বিষয়ে আইএমএফ ইতিবাচক ভূমিকায় রয়েছে— বলছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।

গত জুলাইয়ে কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে সংঘাত-সংঘর্ষ, কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধের প্রেক্ষাপটে বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাবে না বলে হুমকি দেন প্রবাসীরা। প্রতিবাদ হিসেবে দেশে বৈধ পথে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স না পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন করেছেন অনেক প্রবাসী। যার প্রভাব পড়েছিল প্রবাসী আয়ে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে ১৯০ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। তবে ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর আবার দেশ গঠনে বৈধপথে রেমিট্যান্স পাঠানোর বিষয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। এর ফলে আবারও প্রবাসী আয় বাড়তে শুরু করে। আগস্ট মাসে দেশে প্রবাসী আয় বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার বা ২২২ কোটি মার্কিন ডলারে। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশে বৈধপথে ব্যাংক চ্যানেলে ২ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বা ২৪০ কোটি ৪৮ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। দেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ২৮ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে)। কোনো একক মাসে এত প্রবাসী আয় গত চার বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। গত জুন মাসে ব্যাংক চ্যানেলে ২৫৪ কোটি ডলার এবং তারও আগে ২০২০ সালের জুলাইয়ে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে ১৯১ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা আগের ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৩৩ কোটি ডলার।