গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর রাষ্ট্র পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের বয়স এখনও ১০ সপ্তাহ হয়নি। এরই মধ্যে তিনটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে সরকার। প্রথমটি হচ্ছে, দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন, দ্বিতীয়টি হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ আর তৃতীয়টি হচ্ছে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। এই তিন ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও সাধারণ নাগরিকরা সচেতন রয়েছেন। জাতীয় নির্বাচন দ্রুত অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় ভূমিকায় থাকলেও এ নিয়ে সাধারণ মানুষের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হচ্ছে নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। তারা বাজারে সুস্থ মানসিকতা নিয়ে গেলেও ফিরছেন বিরক্ত হয়ে। আর সামগ্রিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও শঙ্কা কাটেনি।
পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগুলো সরকারকে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে চাপ দিয়ে আসছে। যদিও এই চাপকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ‘মৃদু চাপ’ হিসেবে দেখছেন। কারণ, সরকারের কাছে দ্রুত নির্বাচন আদায়ে কোনো রাজনৈতিক দলই রাজপথে কোনো মিছিল-মিটিং বা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেনি। দলগুলো দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে সরকারের নানা দুর্বলতা তুলে ধরে নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানিয়ে আসছে। দলগুলো বলতে চাচ্ছে, নির্বাচিত সরকারই দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে দ্রুত নির্বাচন দিলে নির্বাচিত সরকারই নতুন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভালো ভূমিকা রাখবে। গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব যাত্রা শুরু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। এ সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ইতোমধ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওইসব বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে সরকারকে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপি সরকারের কাছে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছে। একইদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে নির্বাচনের তাগিদের পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারে চাপ দেয় জামায়াতে ইসলামী। এরপর রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে অনুষ্ঠান করে দলটি রাষ্ট্র সংস্কারে ১০ দফা প্রস্তাবনা দেয়। এছাড়াও দলীয় কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। ঠিক একইভাবে গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্যসহ রাজপথে থাকা অন্যান্য রাজনৈতিক দলও দ্রুত নির্বাচন দাবি করছে। ফলে সরকার সংস্কারের পাশাপাশি একটি গ্রহণযোগ্য ও প্রশ্নহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও চ্যালেঞ্জে রয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন নিয়ে সক্রিয় ও সোচ্চার থাকলেও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে নতুন নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। তারা চায় স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন চালাতে। কিন্তু বিপত্তি বাধছে প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান ও নিত্যপণ্যের সীমাহীন উচ্চমূল্য। এখন আর সাধারণ মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে সংসার চালাতে পারছে না। কারণ, বাজারে পণ্য থাকলেও মানুষের পকেটে প্রয়োজনীয় অর্থকড়ি নেই। গরিবের খাদ্য হিসেবে বিবেচিত অনেক পণ্যই এখন ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। বাজার পরিস্থিতি বেসামাল খারাপের দিকেই। মাছ ও ব্রয়লার মুরগির মূল্য মোটামুটি থাকলেও অন্য প্রায় সবকিছুর দামই আকাশছোঁয়া। বিশেষ করে সবজির মূল্য অনেক বেশি। পেঁপে ছাড়া অন্য প্রায় সব সবজির মূল্য ৮০ টাকার ওপরে। সরকারের তরফ থেকে ডিমের মূল্য কমেছে বলে দাবি করা হলেও বাস্তবে মূল্য খুব একটা কমেনি। ভোক্তাদের ভাষ্য, সরকার সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে পারছে না; ফলে মূল্য নিয়ন্ত্রণে আসছে না। তারা বলছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করার পর এমনিতেই কিছু পণ্যমূল্য কমে গিয়েছিল, তখন সবাই বলাবলি করছিলেন সিন্ডিকেটচক্র ভীত হয়ে পড়েছে। কিন্তু এখন তারা নানাভাবে পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে; ফলে আগের মতোই সিন্ডিকেট রয়ে গেছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সরকারের সমালোচনা কম হচ্ছে না, বিশেষ করে কাঁচামরিচের কেজি ৪০০ টাকা— এমন তথ্য দিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। এর আবার কাউন্টারও দিচ্ছেন কেউ কেউ।
বেসরকারি টেলিভিশনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা তার ফেসবুক আইডিতে লিখেছেন— ‘দুই মাসেই এতো অস্থির হয়ে গেছেন!’ আরেকজন বেসরকারি চাকরিজীবী তার ফেসবুক আইডিতে গত বছরের ১ জুলাইয়ের একটি খবরের স্ক্রিনশর্ট দিয়ে কাউন্টার দিয়েছেন। তাতে ওই সময় কাঁচামরিচের কেজি ১২০০ টাকা উল্লেখ রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিতর্ক যা-ই হোক, সাধারণ মানুষ নিত্যপণ্যমূল্য নিয়ে অতিষ্ঠ ও ক্ষুব্ধ। ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা নতুন সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
একইভাবে অন্তর্বর্তী সরকার দুই মাসের বেশি সময় দেশ পরিচালনা করলেও স্বাভাবিক গতি আসেনি প্রশাসনে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরা কর্মস্থলে ফিরলেও কর্মচাঞ্চল্য ফেরেনি। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগাতে পারাও সরকারের জন্য আরেক চ্যালেঞ্জ।