রাজপথে সক্রিয় থাকা রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভাব্য জাতীয় নির্বাচন ও রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে সোচ্চার রয়েছে। দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতাদের দেয়া বক্তব্যে অনেক ক্ষেত্রে বিতর্কের পর্যায়েও পৌঁছে যায়, এতে কর্মী-সমর্থকদের মনের মধ্যে সংশয়সহ নানা প্রশ্ন দেখা দেয়। তৃণমূলে জুলাই-আগস্ট বিল্পবে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সহযোগীর ভূমিকায় থাকা দলগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হলো কি-না এমন প্রশ্নও সামনে চলে আসে। কিন্তু অভ্যন্তরে ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। জাতীয় স্বার্থে দলগুলো অনেকটাই ঐক্যবদ্ধ।
তাছাড়া জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতারও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে তারা বিএনপির সঙ্গে একটি আনুষ্ঠানিক বৈঠকও করেছেন। পর্যায়ক্রমে অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও বসতে পারেন এই বিপ্লবী নেতারা।
সম্প্রীতি, বৈষম্যহীন ও একটি মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বিএনপির অবস্থান কি হবে এমন প্রশ্ন করা হয় দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে। দৈনিক আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের করা প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপি চায় একটি সম্প্রীতির রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে। বিগত সময়ে যারা রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল এমন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি ইস্পাতসম ঐক্য চায় বিএনপি। তিনি এ-ও জানান, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বিগত দিনে জাতীয় সরকার গঠনের যে ধারণা দিয়েছিলেন বিএনপি এখনো সেই অবস্থানেই রয়েছে। বিএনপি চায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সব দলকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পরিচালনা করতে। বিএনপির অন্যতম এ শীর্ষ নেতার বক্তব্যে রাজপথে ফ্যাসিবাদবিরোধী সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের কথা স্পষ্টই বুঝা যায় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তারা বলছেন, অনেকেই ধারণা করেছিলেন হয়তো ফ্যাসিবাদবিরোধী বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকতে পারে। বিষয়টি কিন্তু তা নয়, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও দেশ ও জনগণের স্বার্থে তারা ঐক্যবদ্ধ। এমন অনেক উদাহরণও সামনে রয়েছে। যেমন- গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ‘জুলাই-আগস্ট’ বিল্পবে জীবন উৎসর্গকারী শহীদ পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময়ের আয়োজন করে জামায়াতে ইসলামী। দলটির আয়োজনে সমর্থন জানিয়ে এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ। তিনি ওই সময় দীর্ঘ বক্তৃতাও করেন। একই দিন রাজধানীর ইস্কাটনে বিয়াম মিলনায়তনে দৈনিক নয়াদিগন্ত পত্রিকার ২০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সভায় অংশ নেন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর একাধিক নেতা।
এই অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকনসহ বেশ কয়েকজন নেতা অংশ নেন। সবাই দেশের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালানোর তাগিদ দেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান গত শুক্রবার গাজীপুর মহানগরীর নগপাড়া এলাকার একটি কমিউনিটি সেন্টারে গাজীপুর জেলা জামায়াতের উদ্যোগে আয়োজিত দলের জেলা রুকন সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। জাতীয় সংকটে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে জামায়াতের আমির বলেন, দেশে-বিদেশে এত মানুষ ত্যাগ স্বীকার করল হাজার প্রাণের বিনিময়ে, এখন জনগণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেলো। দেশের মৌলিক স্বার্থে দলগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের বিভাজন এই জাতি কামনা করে না। সংকট এসেছে, সংকট আছে, সংকট থাকবে। সব জাতীয় সংকট ঐক্যবদ্ধভাবে এ জাতি মোকাবিলা করবে।
তিনি বলেন, আমাদের স্পষ্ট ঘোষণা, আমরা একটা মানবিক বাংলাদেশ চাই। যে বাংলাদেশে প্রত্যেকটি নাগরিক, একটি শিশুর জন্ম নেয়া থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তার প্রত্যেকটি নাগরিক অধিকার তার নামে তুলে দিতে রাষ্ট্র বাধ্য থাকে। একটি শিশু জন্ম নেয়ার পর তার মৌলিক পাঁচটি বিষয় তার হাতে তুলে দিতেই হবে। সন্তানদের শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ফেলার আগেই তার হাতে কাজের সোর্স যাবে অর্থাৎ মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত জায়গায় তার স্থান হবে সেই নিশ্চয়তা রাষ্ট্রকে দিতে হবে। এখানে মামা-খালার কোনো জায়গা নেই। মামা বলে, দল বলে সে চাকরি পেয়ে যাবে, আর যার মামা নেই, খালু নেই তার মেধা থাকলেও চাকরি পাবে না— এই বৈষম্যের যাঁতাকলে এ জাতি পিষ্ঠ ছিল, এ থেকে আমরা পরিত্রাণ দিতে চাই। জাতি-ধর্ম, দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশ আমাদের সবার। প্রিয় দেশ শান্তিতে থাকবে, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে, মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত হবে, প্রতিটি নাগরিক মর্যাদাবান নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিয়ে স্বস্তিবোধ করবে। আমরা চাই দেশে-প্রবাসে যারাই আছেন, তারা একজন গর্বিত বাংলাদেশি হিসেবে যেন নিজের পরিচয় সানন্দে প্রকাশ করতে পারেন।
জামায়াতে ইসলামী এমন একটি মানবিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখে, যে সমাজে সীমাহীন বৈষম্য থাকবে না এবং মানুষের অধিকারের প্রতি কেউ হস্তক্ষেপ করার দুঃসাহস দেখাবে না। যারা দেশ পরিচালনা করবে, তারা হবে নিরেট জনগণের খাদেম। গত শনিবার বগুড়ায় এবং গতকাল রোববার ঢাকার চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে দেয়া বক্তৃতার সময়ও জামায়াত আমির ঐক্যের কথা বলেন। একইভাবে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা দেশ ও জাতি গঠনে সম্মিলিত প্রচেষ্টার কথা বলছেন।