ফেরত আসবে পাচারকৃত টাকা

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: অক্টোবর ৩০, ২০২৪, ১১:৪৯ পিএম
  • পাচার অর্থ ফেরাতে সহযোগিতা দেবে আন্তর্জাতিক মহল
  • ব্যাংকের ৯৫ শতাংশ আমানত সুরক্ষিত হবে

নামে-বেনামে, যখন-তখন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ গড়ে তুলেছিলেন দেশের অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি এবং পতিত সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা। এতদিন পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে— এমপি-মন্ত্রীরা মুখে এমন বুলি আওড়ালেও সেসবই ছিল কথার কথা। তবে এবার মুখে কথা নয়, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবে সরকার পতনের পর দায়িত্ব নেয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে কার্যকরী উদ্যোগ নিয়েছেন। নতুন করে যাতে দেশ থেকে টাকা পাচার হতে না পারে, সেজন্য দেশের প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি গ্রুপ ও তার পরিচালকদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ ও দুর্নীতি-সন্দেহজনক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে বেশকিছু অ্যাকাউন্ট ইতোমধ্যে জব্দ করা হয়েছে। তবে সেই সংখ্যা কত, তা স্পষ্ট করেননি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে তারপরই পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আসবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে মামলাও করা লাগতে পারে। 

বিএফআইইউর একটি সূত্র জানায়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তি রয়েছে, ওই চুক্তির মাধ্যমেই পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব। এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে জোর তৎপরতা শুরু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিএফআইইউ, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং সিআইডির সমন্বয়ে জোর তৎপরতা শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ব্যাংকও বাংলাদেশ ব্যাংকে এক্ষেত্রে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। 

বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন,  পাচার হওয়া অর্থ ফেরানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দক্ষতার অভাব রয়েছে। এজন্য আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্য নেয়া হবে। তিনি বলেন, বিদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে অগ্রাধিকার দিয়ে কোন কাজগুলো করতে হবে, তা নির্দিষ্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে। এজন্যই আমরা বারবার আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কথা বলেছি।

ওয়াশিংটন থেকে দেশে ফিরে ইতোমধ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে যা যা করা দরকার, সবকিছু করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকসহ বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মহল পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে কারিগরি সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র আরও জানান, সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াশিংটন সফরে গভর্নর এ নিয়ে পাঁচটি বৈঠক করেছেন। অপরদিকে ফেডারেল রিজার্ভের সঙ্গেও গভর্নরের পৃথক বৈঠক হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিকিউরিটি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ফেড টেকনিক্যাল সহযোগিতা দেয়ারও আশ্বাস দিয়েছে। 

ওয়াশিংটনভিত্তিক আর্থিক খাতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্যমতে, প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছে, গত প্রায় দেড় যুগে দেশের ১৯ ব্যাংকে আত্মসাৎ করা ২৪টি ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমেই প্রায় ১০০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে বেশ কয়েক বছর আগেই বাংলাদেশ বহু দেশের সঙ্গে একাধিক চুক্তি করে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সেসব চুক্তি এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ জারি রাখতে পারে বর্তমান সরকার।

ব্যাংক গ্রাহকের আমানত সুরক্ষায় আইন : আস্থার সংকটে ব্যাংকে টাকা রাখার পরিবর্তে সাধারণ মানুষ এখন হাতে টাকা রাখছে। এতে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকার পরিমাণ দিন দিনই বেড়ে চলছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী গত জুলাই মাসে দেশের মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৯১ হাজার ৬৩০ কোটি চার লাখ টাকা। আর আগস্ট মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি চার টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৮০৪ কোটি ৯ লাখ টাকা। আস্থার সংকট দূর করতে ব্যাংকে রাখা গ্রাহকের আমানত যাতে সুরক্ষিত থাকে, সেজন্য আইন আরও পরিবর্তন করা হবে। এর মাধ্যমে আমানতকারীদের সুরক্ষার মাত্রা আরও বৃদ্ধি করা হবে বলে জানিয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, আমানত সুরক্ষা আইনটি চূড়ান্ত হলে ব্যাংক খাতের ৯৫ শতাংশ আমানতকারী সুরক্ষিত হবে। অপরদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর নিশ্চয়তা দিয়েছেন, শতভাগ বিনিয়োগকারী সুরক্ষিত থাকবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, আমানতকারীদের পক্ষে আমরা কাজ করছি। এজন্যই ব্যাংকগুলো সংস্কারে হাত দিয়েছি। যারা ব্যাংক খাত বোঝেন— এমন ব্যক্তিদের নিয়ে বোর্ড গঠন করা হয়েছে। আমানতকারীদের টাকা চাহিদামতো ফেরত দেয়ার জন্য তারল্য সহায়তা দেয়ার সুযোগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন করে টাকা না ছাপিয়ে অন্য ব্যাংকের মাধ্যমে ধার করার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, আমানতকারীদের টাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, সব আমানতকারীকে একটু ধৈর্য ধরতে হবে। এখন গ্রাহকের চাহিদামতো টাকা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, ব্যাংকের শাখাগুলোতে পর্যাপ্ত টাকা নেই। এ জন্য গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।

নভেম্বরে ব্যাংকের সম্পদ মূল্যায়ন 
—ড. আহসান এইচ মনসুর

নভেম্বর মাস থেকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দিয়ে ব্যাংকগুলোর সম্পদ মূল্যায়নের কাজ শুরু হবে। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসিতে সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বার্ষিক সভায় যোগ দিয়ে বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা। তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ দাতা সংস্থাগুলোর কাছে তুলে ধরেন নতুন এক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার রোডম্যাপ।

প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হয় ব্যাংক ব্যবস্থাপনাসহ ভগ্নদশায় থাকা দেশের আর্থিক খাতের শুদ্ধতায় আনা পরিবর্তনগুলো। আর নভেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দিয়ে সম্পদ মূল্যায়নের কাজ শুরু হবে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। তিনি বলেন, সম্পদ মূল্যায়নের কাজ শুরু করতে রোডম্যাপ তৈরি করা রয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দিয়ে যাচাই-বাছাই করে কোন ব্যাংক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি নিরূপণ করা হবে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব কোন পথে, কীভাবে হবে— এ নিয়ে মার্কিন সরকারের নীতি-সহায়তাও চেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গভর্নর জানান, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বিশ্বব্যাংকের কাছে নীতি-সহায়তা চাওয়া হয়েছে।