ঋণের টাকা উদ্ধার

শীর্ষ ১০ গ্রুপে রিসিভার নিয়োগ

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: নভেম্বর ৪, ২০২৪, ০৮:১০ পিএম

রিসিভার নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন
—কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুখপাত্র

এস আলমের জামানতকৃত সম্পত্তি নিলামে ওঠাল জনতা ব্যাংক

জনতা ব্যাংকে বেক্সিমকোর ঋণ ২৭ হাজার কোটি টাকা

সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নামে-বেনামে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ নিয়ে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় বানিয়েছে শীর্ষ ১০টি গ্রুপ। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক থেকে নেয়া সেই ঋণের টাকার বেশিরভাগই বিদেশে পাচার করেছেন সংশ্লিষ্ট গ্রুপের মালিকরা। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক সেই টাকা উদ্ধারে ওইসব প্রতিষ্ঠানে রিসিভার (তত্ত্বাবধায়ক) নিয়োগের প্রক্রিয়া হাতে নিয়েছে।  রিসিভারের কাজ হলো সংশ্লিষ্ট গ্রুপের ব্যাংক ঋণের বিপরীতে জামানত এবং তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি খুঁজে বের করা এবং সেই সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করা। ইতোমধ্যেই সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাবেদের আরামিট গ্রুপের স্থাবর অস্থাবর এবং বিদেশে থাকা সম্পত্তির সন্ধানে রিসিভার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, রিসিভার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নাম থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো— এস আলম গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, আরামিট গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, সামিট বসুন্ধরা গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, নাবিল গ্রুপসহ মোট ১০টি শিল্প গ্রুপ। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তার কাছে জানতে চাইলে তিনি এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘রিসিভার নিয়োগের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। 

এদিকে, বকেয়া ঋণের টাকা আদায়ে গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন এবং এস আলম গ্রুপের অন্যান্য সম্পত্তি থেকে পাওনা আদায়ের জন্য অতিরিক্ত আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে জনতা ব্যাংক। এস আলম গ্রুপের কাছ থেকে এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য জনতা ব্যাংক গ্রুপটির অন্যতম সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিটেডের জামানত সম্পত্তি নিলাম করার ঘোষণা দিয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে গত ১৫ বছরে এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মধ্যে এই প্রথমবারের মতো একটি ব্যাংক গ্রুপটির একটি কোম্পানির বন্ধক রাখা সম্পদ নিলামে ওঠানোর পদক্ষেপ নিলো। গত ১ নভেম্বর জনতা ব্যাংক পত্রিকায় নিলাম সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আগামী ২০ নভেম্বরকে নিলামের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ তথ্য অনুযায়ী, এ ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখা হয়েছে চট্টগ্রাম ও গাজীপুরে এস আলম গ্রুপের ১৮৬০ শতাংশ জমি, যার বাজারমূল্য সর্বোচ্চ ৩৫৮ কোটি টাকা। এ দাম পাওনা টাকার চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ কম। এ সম্পত্তি বিক্রি করে খেলাপি ঋণ পুরোপুরি আদায় করা সম্ভব নয়। বকেয়া বাকি টাকা আদায়ে আরও আইনি পদক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে। অর্থঋণ আদালত আইনের ১২(৩) ধারা অনুযায়ী ব্যাংক মামলা করার আগেই জামানতের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা আদায় সম্ভব। বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-এর ২০২১ সালের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকা না মেনে ঋণসীমা অতিক্রম করে অতিরিক্ত ঋণ নিয়েছে। এস আলম গ্রুপের ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন শিল্প কাঁচামাল, বাণিজ্যিক পণ্য এবং নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসায় জড়িত ছিল। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালে সাধারণ বিমা ভবনে অবস্থিত জনতা ব্যাংকের চট্টগ্রাম কর্পোরেট শাখা থেকে গ্লোবাল ট্রেডিং কর্পোরেশন প্রাথমিকভাবে ৬৫০ কোটি টাকা ঋণ নেয়। এ ঋণ ২০২১ সাল পর্যন্ত সুদে আসলে মোট এক হাজার ৭০ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৬১৭.৪৭ কোটি টাকা পিএডি (পেমেন্ট এগেইনস্ট ডকুমেন্ট), ২২৩.১৮ কোটি টাকা এলটিআর (ট্রাস্ট রিসিপ্ট) ঋণ এবং ২২৯.৯৯ কোটি টাকা সিসি হাইপো ঋণ। সুদাসল মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এক হাজার ৮৫০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান শুধু জনতা ব্যাংকের এক শাখা থেকেই ঋণের নামে বের করেছেন প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। যা ওই শাখার মোট ঋণের ৬৫ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ এবং গ্রুপ সম্পর্কিত মোট ৩২টি প্রতিষ্ঠানের নামে ২৬ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা ঋণ নেয়া হয়। এছাড়া পুঁজিবাজারের সুকুক বন্ডের নামে নেয়া হয় ২২০ কোটি টাকা। এসব ঋণের বেশিরভাগই ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের জুলাই মাসে নেয়া।