ইতিহাস তৈরি করে ক্ষমতার মসনদে ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন কূটনৈতিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা। ইতিহাস বলে, মার্কিন সরকার পরিবর্তন হলেও দেশটির পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন হয় না। ট্রাম্পের বিজয়ে অতীতের চেয়ে বেশি সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান সরকারপ্রধান ড. ইউনূসের বিশ্ব-ব্যক্তিদের সঙ্গে অতীতের চাইতে বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া এবার হাজার হাজার ছাত্র-জনতার রক্তে বিজয় পাওয়া বাংলাদেশের দুনিয়াজুড়ে নতুন পরিচয় রয়েছে। অধিকার আদায় এবং গণতন্ত্র রক্ষায় অভ্যুত্থান মার্কিন সরকারের কাছে অধিক গুরুত্ব পাবে।
অভিজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের হিন্দুরা পৃথিবীর অন্য দেশের চেয়ে বেশি নিরাপদ। হাসিনা সরকার দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর হিন্দুদের নিরাপত্তা ও রক্ষায় বাংলাদেশ যে ভূমিকা পালন করেছে বিশ্ব দরবারে তা প্রশংসা কুড়িয়েছে। নির্বাচন-পূর্ব ট্রাম্প বাংলাদেশ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা রাজনীতির অংশ, হিন্দু ভোটারদের ভোট নিশ্চিত করতেই এমন করেছেন। ওই মন্তব্যের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের কোনো গভীরতা নেই। এবার মার্কিন সরকার ইচ্ছে করলেও বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে পারবেন না। রক্ত স্রোতে পাওয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিজয় কোনো রাজনৈতিক বিজয় নয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিজয় সব হিসাব থেকে ভিন্ন। এখানে বিপ্লবীরা সংস্কার পর্যন্ত সময় নিয়ে তারপরই নির্বাচনের পথে হাঁটবেন। সেখানে অযৌক্তিক কোনো নীতি গ্রহণ করবে না মার্কিন সরকার।
এদিকে মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। ইতোমধ্যে শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়ে ওঠার পাশাপাশি স্বর্ণ ও অপরিশোধিত তেলের দাম কমে গেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি আউন্স সোনার দাম ১৮ ডলার কমে ২৭৩১ ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত তেলের দাম ১ দশমিক ১৭ ডলার কমে ৭০ দশমিক ৮২ ডলারে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ডাও জোন্স ১১১৪ পয়েন্ট বেড়ে ৪৬৪৯৫-এ রয়েছে। বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় একক বাজার যুক্তরাষ্ট্র। প্রতিবছর মোটামুটি ১০ বিলিয়ন বা এক হাজার কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। এই রপ্তানির বেশির ভাগই তৈরি পোশাক। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হিস্যার ৯ শতাংশ দখলে নিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে চীন আর ভিয়েতনাম। ট্রাম্প সরকার যদি তার ট্যারিফ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, তবে তা বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হতে পারে। চীনের ওপর অতিরিক্ত ট্যারিফ বসানো হলে চীন তখন বাংলাদেশের মতো দেশগুলোকে বেছে নিবে পণ্য উৎপাদনের জন্য। যা বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশের জন্য সুযোগ বয়ে আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের বিশাল বাজার ধরতে পারবে এসব দেশ। কারণ, এসব দেশকে তুলনামূলক কম শুল্ক দিতে হবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো প্রভাব পড়বে না। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রাতিষ্ঠানিক রাষ্ট্র। এটি ব্যক্তিনির্ভর কোনো রাষ্ট্র নয়। এখানে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। এটা নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। ট্রাম্প রিপাবলিকান দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক একই থাকবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বৈশ্বিক শক্তি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তারা বড় রাষ্ট্রগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেই ক্ষমতায় আসুক বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়বে না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বর্তমান বিশ্বের যে জটিল পরিস্থিতি রয়েছে তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফলাফল আরও সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখবে বলে মনে করি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ বহুদিন ভোট দিতে পারিনি বিভিন্ন কারণে, সেহেতু অন্য দেশের ভোটের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেদের জন্য আমরা বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে চাই।
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচাম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতি দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই খারাপ কিছু হওয়ার সুযোগ নেই। বরং বাংলাদেশের জন্য ভালো হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। একই সঙ্গে নতুন যারা আসবে তাদের সঙ্গে সঠিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে পারলে বাংলাদেশ বেনিফিটেব হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যিনিই নির্বাচিত হন, তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে না। তার নির্বাচনি প্রচারণার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, তিনি করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে দেবেন। এতে বাজেট ঘাটতি বাড়বে। ফলস্বরূপ, মার্কিন সরকারের অন্যান্য দেশের উন্নয়ন বাজেট এবং সাহায্য হ্রাস পেতে পারে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী হওয়ায় তিনি ব্যবসায়ী সমপ্রদায়ের জন্য ভালো হবেন। যদি চীনা পণ্যের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক পরিকল্পনা কার্যকর করা হয়, তাহলে অনেক মার্কিন পোশাক খুচরা বিক্রেতা এবং ব্র্যান্ড পোশাক পণ্যের সোর্সিং স্থানান্তর করার চেষ্টা করবেন। এটি অন্যান্য দেশ ও একটি বড় সরবরাহকারী হিসেবে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হলেও চীনের জন্য বিদ্যমান মার্কিন শুল্ক অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
সংস্কার কমিশনের প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার একটি অনুষ্ঠানে বলেন , যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের ফল বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব পড়বে, এমনটি মনে করি না। যদিও ট্রাম্প একটি টুইট করেছেন এবং এটি তার ভোটের বিবেচনায় ভারতীয়দের ভোট পাওয়ার জন্য করেছেন। আমি নিশ্চিত ট্রাম্প বাংলাদেশ কোথায় সেটিও জানে না। আমার মনে হয় না এটির কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক আরও উচ্চ শেখরে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হবে। রিপাবলিকান অনেক নেতার সঙ্গেও প্রধান উপদেষ্টার ভালো সম্পর্ক রয়েছে।