উপদেষ্টা নিয়োগেছাত্র-জনতার রক্তের সঙ্গে মশকরা করা হচ্ছে
—হাসনাত আব্দুল্লাহ
বিতর্কিতরা উপদেষ্টা হওয়ার জন্য দুই হাজার মানুষ জীবন দেয়নি
—আব্দুল হান্নান মাসুদ
হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিজয় চব্বিশের জুলাই। সম্প্রতি দফায় দফায় যাদের উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, তা ছাত্র-জনতার চাওয়া-চাহিদার বিপরীত বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, আওয়ামী লীগের অনুগত ব্যক্তিরা উপদেষ্টা পদে আসছেন। আবার ছাত্রহত্যার আসামিও উপদেষ্টা পদে শপথ নিয়েছেন, যা দুই হাজার শহীদ ও ৩০ হাজার আহত পরিবারের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এভাবে অদৃশ্য সিগন্যালে ছাত্র-জনতাকে না জানিয়ে যদি একের পর স্বৈরাচারের অনুগতদের পুনর্বাসন করা হয়, তাহলে যারা বঙ্গভবনে বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
উপদেষ্টা নিয়োগে ছাত্র-জনতার রক্তের সঙ্গে মশকরা করা হচ্ছে মন্তব্য করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, শিক্ষার্থীরা যখন ‘মুজিববাদ মুর্দাবাদ’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগতদের উচ্ছেদে কাজ করছে, ঠিক তখন আমরা খবর পাই বঙ্গভবন থেকে উপদেষ্টা ঠিক করা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার মতামত না নিয়ে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী চরিত্র ধারণ করে এমন কাউকে উপদেষ্টা পরিষদে মেনে নেয়া হবে না। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টে যেসব ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে, আহত হয়েছে, তাদের চাওয়া বা আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থি ব্যক্তিদের আমরা উপদেষ্টা পরিষদে দেখতে চাই না। গতকাল সোমবার বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত সমাবেশে থেকে তিনি এই হুঁশিয়ারি দেন।
হাসনাত বলেন, ধানমন্ডির ৩২কে যারা কাবা মনে করে, তাদের উপদেষ্টা করা হয়েছে। কার মদতে, প্রশ্রয়ে আওয়ামী পুনর্বাসনের এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে আমরা তা জানতে চাই। ফ্যাসিবাদের যারা দোসর, ২৪-পরবর্তী বাংলাদেশে কোনো ফরম্যাটেই তাদের দেখতে চাই না। উপদেষ্টা হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, গত ১৬ বছরে তারা কী করেছে, তার ইতিহাস আমরা জানতে চাই। তিনি বলেন, আমাদের হারাবার কিছু নেই। ৫ আগস্টের পর আমাদের বোনাস লাইফ।
হাসনাত বলেন, শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের রক্তকে পুঁজি করে উপদেষ্টার পদ বাগিয়ে নেয়া হলে ভুল করবেন। ছাত্র-জনতার মতামত না নিয়ে কোন অদৃশ্য সিগন্যালে উপদেষ্টা নিয়োগ দিচ্ছেন, তার জবাব দিতে হবে। আপনারা স্বৈরাচারের অনুগতদের যদি পুনর্বাসনের ম্যান্ডেট নিয়ে থাকেন, তাহলে তার কঠিন জবাব দিতে হবে। কারো সঙ্গে আলোচনা না করে উপদেষ্টা নিয়োগের মশকারি বন্ধ করুন। যদি উপদেষ্টা নিয়োগে এভাবে অনিয়ম চলতে থাকে, তাহলে সেসব উপদেষ্টার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা আবারও রাস্তায় নামবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তাদের যাকে-তাকে উপদেষ্টা বানানোর ক্ষমতা দেয়া হয়নি। তিন মাস পার হয়ে গেছে, এখনো আমাদের সব উপদেষ্টাকে ছাত্র-জনতা ঠিকভাবে চেনেন না। উপদেষ্টারা কাদের কাছে দায়বদ্ধ, তা স্পষ্ট করতে হবে। আপনাদের স্মরণে থাকতে হবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আপনারা ক্ষমতায় বসেছেন। গত পরশু যেসব উপদেষ্টাকে বসানো হয়েছে, তাদের বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। এর আগে যাদের বসানো হয়েছে, তাদের ব্যাপারে আমরা কিছুটা অবগত ছিলাম। গত তিন মাসে উপদেষ্টারা কী কাজ করেছেন, তা জাতির সামনে উপস্থাপন করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে উপদেষ্টারা কী কী কাজ করছেন বা কী উন্নতি করছেন, আমাদের তা জানাতে হবে। রক্তের বিষয়ের দায়বদ্ধতা পূরণ করতে না পারলে পদ ছেড়ে দিন। বিতর্কিত ব্যক্তিরা ক্ষমতার আসনে যাওয়ার জন্য দুই হাজার মানুষ শহীদ হয়নি। এসি রুমে বসে শুধু সাইন করার জন্য আপনাদের নিয়োগ দেয়া হয়নি শেখ হাসিনার অনুগত সচিবদের বাদ দিয়ে বিপ্লবের পক্ষে কজন সচিবকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তা স্পষ্ট করতে হবে। ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত কতজন সচিবকে বাদ দিয়েছেন, তাও স্পষ্ট করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা আপনাদের এখন ভালো চোখে দেখছি; কিন্তু কাল যদি রক্তের বিজয়ের পক্ষে কাজ না করেন, তাহলে নামিয়ে ফেলতে একটুও ভাবব না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হাজার হাজার শহীদ পরিবারের কাছে দায়বদ্ধ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন হাজার হাজার আহত পরিবারের কাছে দায়বদ্ধ। আজ ও আগামীতে যদি উপদেষ্টারা তাদের কাজের অগ্রগতি প্রতি সপ্তাহে গণমাধ্যমে তুলে না ধরেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তারা কেউ ছাত্র-জনতার আদর্শ ধারণ করেন না।
সেখ বশিরের বিরুদ্ধে রয়েছে হত্যামামলা : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সোহান শাহ নামে (৩০) এক যুবককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মামলায় আসামির তালিকায় নাম রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়া ব্যবসায়ী সেখ বশির উদ্দিনের। ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’র নামের সঙ্গে শুধু একটি বর্ণের অমিল রয়েছে। সেখ বশিরের বাবার নামের সঙ্গে আসামির তালিকায় থাকা ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’র বাবার নামের আংশিক মিল রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া’ নাম দিয়ে সেখ বশির উদ্দিনকে আসামি করা হয়েছে কি না। বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন। তিনি বলেছেন, নামের আংশিক সংগতি ও অসংগতি থাকলেও তিনি নিশ্চিত নন মামলাটি তার নামে হয়েছে কী না। অন্যদিকে পুলিশ বলছে, শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া ও সেখ বশির উদ্দিন একই ব্যক্তি কী না, তারা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মামলার বাদী নিহত সোহান শাহর মা সুফিয়া বেগম সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ তার ছেলে হত্যার জন্য দায়ী। সোহান হত্যা মামলাটি গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীর রামপুরা থানায় রেকর্ড করা হয়। মামলার নথিপত্র বলছে, এতে মোট ৫৭ আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ২০০ থেকে ৩০০ জনকে।
মামলার বিষয়টি নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন সেখ বশিরের কাছে। তিনি বলেন, ‘আমি খুব ভালো জানি না। আমাদের লিগ্যাল টিম বিষয়টি দেখছে। ওখানে (মামলার এজাহার) আমার নামের, আবার বাবার নামের কিছু সংগতি আছে, কিছু অসংগতিও আছে। এটা আসলেই আমি কি না, আমি নিশ্চিত নই। নিশ্চিত হলে লিগ্যালি ফেস (আইনিভাবে মোকাবিলা) করা হবে।’
রামপুরা থানার ওসি আতাউর রহমান আকন্দ বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছেলেকে গুলি করে হত্যার অভিযোগে সুফিয়া বেগম নামে এক নারী ঢাকার আদালতে একটি নালিশি মামলা করেন। আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করার জন্য নির্দেশ দেন। সে মামলায় শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া নামের এক ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছে। ‘শেখ বশির উদ্দিন ভূঁইয়া বর্তমান উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন কি না, সেটি তারা খতিয়ে দেখছেন।