ঘর থেকে ব্যাংকে ফিরছে টাকা

আনোয়ার হোসাইন সোহেল প্রকাশিত: নভেম্বর ১২, ২০২৪, ১২:০৩ এএম

পতিত আওয়ামী শাসনামলে সবচেয়ে বড় সংকটে ছিল ব্যাংক খাত। নামে-বেনামি ঋণ বিতরণ ও ইচ্ছকৃত খেলাপি হওয়া, বিদেশে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার, ব্যাংক পরিচালকদের খামখেয়ালিপনায় ব্যাংক খাতের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা তলানিতে নেমে যায়। চরম তারল্য সংকট দেখা দেয় একডজনেরও বেশি ব্যাংকে। সেই দুর্বল ব্যাংকগুলো এখনো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এতো সংকটের মধ্যেও নতুন গভর্নরের নেয়া পদক্ষেপের কারণে ব্যাংক খাত থেকে তুলে নেয়া নগদ টাকা আবারও ব্যাংকে রাখতে শুরু করেছেন আমানতকারীরা। গত দুই মাসে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যাংকে ফিরেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে যে, গত বছরের নভেম্বর থেকে ব্যাংকে রাখা টাকা তুলে নিজের কাছে রাখার প্রবণতা হঠাৎ বেড়েছিল। এ প্রবণতা ব্যাংকগুলোর ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। নতুন গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের নেয়া কিছু পদক্ষেপের কারণে ব্যাংক খাতে তারল্য প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেশ কিছু কারণে মানুষের হাতে গত ১০ মাস টাকা বেড়েছিল। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা, দুই ঈদের বাড়তি খরচ, ব্যাংক মার্জের খবর এবং জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের প্রভাবে অনেকে টাকা তুলে নিয়েছিল। তাই ব্যাংকের বাইরে টাকা বেড়েছিল। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানা উদ্যোগে স্থিতিশীলতা ফেরায় ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে।

খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, মানুষের কাছে নগদ টাকা বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া বোঝা যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রা সরবরাহের ওপর। ছাপানো নগদ টাকার একটি অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখায় গচ্ছিত থাকে। দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে ব্যাংকগুলোর ভল্টেও কিছু টাকা থাকে। এছাড়া ছাপানো টাকার একটা অংশ থাকে মানুষের হাতে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অক্টোবর শেষে ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৫২ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখায় ছিল ৫১ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা। বাকি অর্থের ২১ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর ভল্টে এবং দুই লাখ ৭৯ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে। অক্টোবর শেষে প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল তিন লাখ এক হাজার ৮১ কোটি টাকা।

যদিও গত আগস্ট শেষে ছাপানো টাকার পরিমাণ ছিল তিন লাখ ৫২ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের চেস্ট শাখায় ছিল ৩৫ হাজার ৯২২ কোটি টাকা। বাকি অর্থের ২৩ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা ব্যাংকগুলোর ভল্টে এবং দুই লাখ ৯৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকা মানুষের হাতে ছিল। তবে ১৫ আগস্ট তা ছিল তিন লাখ এক হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। আগস্ট শেষে প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ ছিল তিন লাখ ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই মাসে মানুষের হাতে থাকা ১৪ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা ব্যাংকে ফিরছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, ব্যাংকে গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসছে। ধীরে ধীরে নগদ টাকা ব্যাংকে রাখতে শুরু করেছেন তারা। সরকার পতনের পর ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকা বেড়ে গিয়েছিল। তা প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। তবে ধীরে ধীরে তা কমে এখন দুই লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে। এতে বোঝা যায়, মানুষ ঘর থেকে ব্যাংকে টাকা ফেরত দিচ্ছে। ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ব্যাংক খাতে সাধারণত প্রতি মাসে আগের মাসের তুলনায় আমানত বাড়ে। তবে, জুলাই ও আগস্ট মাসে আমানত বাড়ার বদলে উল্টো কমে গেছে। চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে আমানত ছিল ১৭ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ, দুই মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছিল প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য ব্যাংক খাত সংস্কারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানান পদক্ষেপের কারণে সেপ্টেম্বরে গ্রাহকদের ব্যাংক থেকে ডিপোজিট তুলে নেয়ার প্রবণতা কমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা।

গত বছরের অক্টোবরে ব্যাংকের বাইরে নগদ টাকার পরিমাণ ছিল দুই লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। পরের মাস নভেম্বরে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৪৮ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা, ডিসেম্বরে দুই লাখ ৫৪ হাজার ৮৬০ কোটি, জানুয়ারিতে দুই লাখ ৫৭ হাজার ২৯৫ কোটি, ফেব্রুয়ারিতে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি, মার্চে দুই লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি, এপ্রিলে বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি, মে মাসে দুই লাখ ৭০ হাজার ৬৫৮ কোটি, জুনে দুই লাখ ৯০ হাজার ৪৩৬ কোটি, জুলাইয়ে দুই লাখ ৯১ হাজার ৬৩০ কোটি এবং আগস্টে বেড়ে দাঁড়ায় দুই লাখ ৯২ হাজার ৪৩৪ কোটি চার লাখ টাকায়।

এদিকে সেপ্টেম্বরে ব্যাংক খাতে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ বা ৯ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকা বেড়ে ১৭ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যদিও আগের মাস আগস্টে মোট আমানত ১৭ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকায় নেমে আসে, যা ছিল জুলাইয়ের তুলনায় ০.১৬ শতাংশ কম। তবে আগের বছরের তুলনায় আগস্টে আমানত প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৭.০২ শতাংশে, যা ১৮ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড ৬.৮৬ শতাংশ সর্বনিম্নে পৌঁছেছিল এই প্রবৃদ্ধি।