আগে মূল্যস্ফীতির হিসাব ছিল নিয়ন্ত্রিত
—আহসান এইচ মনসুর
নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে ১০০ দিনেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি বৈষম্যবিরোধী প্লাটফর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার। বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জ নিলেও এখনো তার সিকি পরিমাণও অর্জন করতে পারেনি এই সরকার। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, শীতের সবজি, আলু-পেঁয়াজ ও পামওয়েলের দাম চড়া। সবজির সরবরাহ পর্যাপ্ত হলেও দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। এদিকে আলু-পেঁয়াজ ও পামওয়েলের দাম কেজিতে বেড়েছে ২০-২২ টাকা পর্যন্ত। নিত্যপণ্যের এমন লাগামহীন দামে বাজারে এসে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।
বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি দরে, যা গত মাসে ৫৫-৬০ টাকা ছিল। লাল আলু বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকা বেশি দামে। দেশি পেঁয়াজের দাম ১১০-১২০ টাকা থেকে এক লাফে উঠেছে ১৪০-১৫০ টাকায়। তবে ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।
কারওয়ানবাজারে আসা ক্রেতা নজরুল ইসলাম আমার সংবাদকে বলেন, আলু, পেঁয়াজ ও তেলের দাম অস্বাভাবিক। সরকার বাজার সিন্ডিকেট ভাঙতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। এই দাম কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু এসব পণ্য এতটাই প্রয়োজনীয় যে বাজারে এলে কিনতেই হয় এর কোনো বিকল্প নেই। অর্ধেক পণ্য কিনতেই পকেট ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আলু-পেঁয়াজের মৌসুম এখন শেষের দিকে। প্রতি বছর এ সময় দাম বাড়ে। তবে এ বছর শুরু থেকেই দাম চড়া। এরপর এখন বেড়ে আরও বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে। সপ্তাহের ব্যবধানে বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের দাম না বাড়লেও খোলা তেলের দাম বেড়েছে। বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল ১৭০ থেকে ১৭১ টাকায় উঠেছে। যেখানে বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৬৭ থেকে ১৭২ টাকা। এছাড়া প্রতি লিটার খোলা পাম তেল ১৬২ থেকে ১৬৩ টাকা ও সুপার পাম তেল ১৬৪ থেকে ১৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ১৮৫ বাজারে ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম গত সপ্তাহ থেকে একটু কম। এখন প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭৫-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা ১৯৫ থেকে ২০০ টাকা উঠেছিল। সোনালি মুরগির দাম ৩১০-৩২০ টাকা প্রতি কেজি।
এ ছাড়া বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ১৫০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।
সবজির বাজারে দেখা গেছে, প্রায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিতে ১০ থেকে ২০ টাকা কমেছে। এসব বাজারে গ্রীষ্মকালীন সবজি কচুরমুখী ৬০ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৭০ টাকা, করলা ৭০ থেকে ৮০ টাকা, পটোল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, ঢেঁড়স ৬০ টাকা, বরবটি ১০০ টাকায়, প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, পেঁপে প্রতি কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা, ধুন্দুল ৭০ টাকা, চিচিঙ্গা ৭০ টাকা, কচুরলতি ৮০ থেকে ১০০ টাকা, ঝিঙা ১০০ টাকা, শসা ৮০ টাকা এবং কাঁচামরিচ ১০০ থেকে ১২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।বাজারে লেবুর হালি ২০ থেকে ৪০ টাকা, ধনে পাতা কেজিতে ৫০ টাকা কমে ১৫০ টাকায় এসেছে, কাঁচা কলা হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়, চাল কুমড়া ৬০ টাকা পিস এবং মিষ্টি কুমড়া ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। লালশাক ১৫ টাকা আঁটি, লাউশাক ৪০ টাকা, কলমিশাক ১৫ টাকা, পুঁইশাক ৪০ টাকা এবং ডাঁটাশাক ৩০ টাকা আঁটি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
গরুর গোশত কেজি প্রতি ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা, গরুর কলিজা ৮০০ টাকা, খাসির গোশত কেজি প্রতি ১১৫০-১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মাছের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারগুলোতে ৫০০ গ্রামের ইলিশ ১ হাজার টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ১৫০০ টাকা, এক কেজি ওজনের ১৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাজারগুলোতে এক কেজি শিং মাছ চাষের (আকারভেদে) বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায়, প্রতি কেজি রুই মাছের দাম বেড়ে (আকারভেদে) ৩৮০ থেকে ৫০০ টাকায়, দেশি মাগুর মাছ ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা, মৃগেল ৩২০ থেকে ৪০০ টাকায়, চাষের পাঙ্গাশ ২০০ থেকে ২২০ টাকায়, চিংড়ি প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ১২০০ টাকায়, বোয়াল মাছ প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায়, কাতল ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়, পোয়া মাছ ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকায়, পাবদা মাছ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়, তেলাপিয়া ২২০ টাকায়, কৈ মাছ ২২০ থেকে ২৩০ টাকায়, মলা ৫০০ টাকা, বাতাসি ১৩০০ টাকায়, টেংরা মাছ ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাচকি মাছ ৪০০ টাকায়, পাঁচ মিশালি মাছ ২২০ টাকায়, রূপচাঁদা ১২০০ টাকা, বাইম মাছ ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা, দেশি কই ১২০০ টাকা, শোল মাছ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, বেলে মাছ ৮০০ টাকা, কোরাল মাছ ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমরা দায়িত্ব নেয়ার আগে মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ন্ত্রিত ছিল। কৃত্রিমভাবে দেয়া হতো হিসাব। বর্তমান সরকার মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হিসাব দিচ্ছে। অক্টোবরের মূল্যস্ফীতি গত তিন মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। সেপ্টেম্বরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯.৯২ শতাংশ ও আগস্টে ছিল ১০.৪৯ শতাংশ। সরকার আমদানি শুল্ক কমালেও পেঁয়াজ, আলু আর ভোজ্যতেলের দাম কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আসছে না। গত এক মাসে আলুর দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা, চালের দাম কেজিতে ৪ থেকে ৫ টাকা, খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১০ থেকে ১২ টাকা, পামওয়েল ২২ টাকা, পেঁয়াজের দাম ২৫ থেকে ৩৫ টাকা, রসুনের দাম ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশ, যা জুলাইয়ে ছিল ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ। অক্টোবরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা এক মাস আগে ছিল ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রায় দুই বছর ধরে ক্রমবর্ধমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর আছে। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ-এর (টিসিবি) তথ্য বলছে, গেল এক মাসে সব ধরনের চালের দর বেড়েছে গড়ে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া খোলা সয়াবিন ও পামওয়েলের দর ১১ শতাংশ, চিনির ১, মসুর ডালের প্রায় ৫, আলুর প্রায় ২২, পেঁয়াজের ২২, রসুনের ১০, রুই মাছের ১০ ও গরুর মাংসের ৩ শতাংশ দর বেড়েছে। অথচ সরকার চাল, তেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ ও ডিম আমদানিতে কোনোটির ক্ষেত্রে শুল্ক পুরোপুরি প্রত্যাহার, কোনোটিতে উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে। তারপর নিত্যপণ্যের বাজারে এর কোনো প্রভাবই পড়েনি।
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে পুরনো সিন্ডিকেট ভাঙা জরুরি। কারসাজি যারা করে, তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলেই নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফিরবে। খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য একজন ক্রেতা হিসেবে আমিও চাপে আছি। অবশ্য বাজারে লাগাম টানতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন সময়ে ভোগ্যপণ্যের দাম বেঁধে দেয়া, অভিযান চালানো, আমদানিতে শুল্ককর কমানো, আমদানির অনুমতিসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তাতেও মিলছে না সুফল।