শেখ হাসিনা যেখানেই থাকুক না কেন গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেয়া হবে
—আসিফ নজরুল
শেখ হাসিনা ফিরে আসুন, এসে বিচারের মুখোমুখি হোন
—আবদুস সালাম
চাইলেই ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়া উচিত
—ডা. শফিকুর রহমান
একশরও বেশিদিন ভারতে পলাতক রয়েছেন শেখ হাসিনা। তার দিল্লিবাস নিয়ে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশের নাগরিকদের একটি বড় অংশ। শেখ হাসিনার নির্দেশে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা গণহত্যার শিকার হয়েছেন। ৩০ হাজারের বেশি মানুষ গুলিতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন। রক্তপিপাসু স্বৈরাচার সরকারের প্রধানকে ফেরত আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে।
গতকাল রোববার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টাও জানিয়েছেন, শিগগিরই পতিত শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচার করা হবে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আজ ১৮ নভেম্বরের মধ্যে গ্রেপ্তার করে তাকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়। একইসঙ্গে ভারতীয় কূটনীতিকরাও বাংলাদেশ সরকারকে সবুজ সংকেত দিয়েছেন শেখ হাসিনাকে দেশে পাঠাতে। সে প্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে।
গত শনিবার ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক সংলাপে ভারতীয় দুজন বিশ্লেষক অভিমত দিয়েছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার বিচার শুরু হলে তাকে বাংলাদেশে ফেরানোর বিষয়ে দুই দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের ওপর আয়োজিত একটি অধিবেশনে বাংলাদেশের একজন আলোচক ভারতীয় অংশগ্রহণকারীদের কাছে জানতে চান— দেশের ভেতরকার রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ হত্যার ঘটনার পর গত আগস্টে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। সেখানকার সরকার তাকে আশ্রয় দেয়। তাকে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ কী করতে পারে।
আলোচনার শুরুতে ভারতীয় বিশ্লেষকরা শেখ হাসিনা ইস্যুটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এক আলোচক বলেন, তিনি প্রসঙ্গটি বুঝতে পারেননি। একপর্যায়ে দেশটির অন্য এক আলোচক বলেন, দুই দেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি আছে। বাংলাদেশ এখনো এ চুক্তির আওতায় তাকে ফেরত চায়নি। ফেরত চাওয়া হলে তারপর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আরেক ভারতীয় আলোচক বলেন, আদালতে শেখ হাসিনার বিচার এখনো হয়নি। বাংলাদেশ সরকার এখনো ভারতকে বলেনি তাকে ফেরত দিতে। ফেরত দেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করা হলে তারপর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা উচিত। আলোচনায় সাংবাদিকদের থাকতে দেয়া হলেও শুরুতেই সঞ্চালক ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক পারভেজ করিম আব্বাসী খোলামেলা আলোচনার সুযোগ তৈরি করতে ‘চাথাম হাউস রুলস’ জারি করেন। এ নীতি অনুযায়ী আলোচনায় অংশ নেয়া কোনো ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশ করে উদ্ধৃতি দেয়া যায় না।
এ নিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, যে খুনি গোষ্ঠী জুলাই-আগস্ট মাসে গণহত্যা চালিয়েছে, যারা পালিয়ে আছে, তাদেরকে ধরার জন্য আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করতে যাচ্ছি। এটা খুব দ্রুতই হবে। তারা যেখানেই থাকুক না কেন, আমরা তাদের গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসার জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেব ও চেষ্টা করব।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে অভিযুক্ত, তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেন্ডিং আছে; কিন্তু বাংলাদেশের জুরিসডিকশনের বাইরে তিনি চলে গেছেন, সে কারণে আন্তর্জাতিক পুলিশিং সংস্থা হিসেবে ইন্টারপোল যাতে তাকে গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা নেয় এবং তার ব্যাপারে অন্তত রেড অ্যালার্ট জারি করে— সে ব্যাপারে আমরা অনুরোধ পাঠিয়েছি।’
মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ও জনকূটনীতিক অনুবিভাগের মহাপরিচালক তৌফিক হাসান জানান, শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরত আনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এখনো কোনো নির্দেশনা আসেনি। শেখ হাসিনার গ্রেপ্তারি পরোয়ানার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত থেকে তাকে ফিরিয়ে আনতে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে— সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে সম্প্রতি তৌফিক হোসেন বলেন, বিষয়টি একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ফেরত আনার বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। নির্দেশনা পেলে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে খুন, গুম ও হত্যা মামলা আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখনই চাইবে, ভারত তখনই শেখ হাসিনাকে ফেরত দেয়া উচিত হবে। তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রতিবেশীকে অনুরোধ করব, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালতে দেড়শতাধিক মামলা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে খুন-গুমের মামলা আছে। আমাদের বিচারক যখন চাইবেন, মেহেরবানি করে তখনই যেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তারা (ভারত) শেখ হাসিনাকে তুলে দেয়। আমরা চাই সাড়ে ১৫ বছর তারা জাতির ওপর যে জুলুম-নির্যাতন করেছে, বিচারের নামে যেসব তামাশা আর অবিচার করেছে— সে বিষয়ে শেখ হাসিনা এবং তার দলের দোসরদের বিরুদ্ধে যেন বিচারটা নিশ্চিত করা হয়।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম বলেন, শেখ হাসিনার আশেপাশে যারা ছিলেন, তাদের এখনও আইনের আওতায় আনা হয়নি। আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মাদের রেখে কোনো সংস্কারই কাজে আসবে না। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই শেখ হাসিনা ফিরে আসুন, এসে বিচারের মুখোমুখি হোন।