নিত্যপণ্যের বাজারের মতো নীরবে দাম বাড়ছে ওষুধের। যারা আগে তিন বেলা ভালোভাবে খাবার খেতে পারেননি, সেই সাধারণ মানুষ এখনো পারছেন না। বৈষম্যবিরোধী সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের পর অনেকেই মনে করেছিলেনর এবার হয়তো সমাজ থেকে কিছুটা হলেও বৈষম্য দূর হবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের সেই প্রত্যাশায় গুঁড়েবালি। প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের চাপ সামাল দিয়ে ওষুধ খেয়ে সুস্থ থাকবেন তারও কোনো উপায় নেই। সম্প্রতি দেশের একটি বৃহৎ ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি স্কয়ার তাদের প্রায় ২৬টি প্রোডাক্টের দাম ১১ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
চলতি মাসেই কোম্পানিটি অতি জরুরি ২৬টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে। এলাট্রল সিরাপ প্রতি পিসে ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেড়েছে, ইপিট্রা ০.৫ ট্যাবলেট প্রতি পিসে বেড়েছে ৬০ শতাংশ, টোরাক্স ট্যাবলেটের দাম বেড়েছে ৬০ দশমিক ৬৬ শতাংশ, এড্রিল সিরাপ প্রতি পিসে বেড়েছে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ, মটিগাট ট্যাবলেট ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ, ফ্লেক্সি-১০০ ট্যাবলেট প্রতি পিসের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশ, ডার্মাসল এন-ক্রিম ১১ দশমিক ১১ শতাংশ, কমেট ট্যাবলেটের দাম বেড়েছে ২৪ শতাংশ, ফেক্সো ট্যাবলেট প্রতি পিসের দাম বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
চলতি বছরের আগস্ট মাসে উৎপাদিত ‘টোরাক্স’ ওষুধটির মেয়াদ শেষ হবে আগামী জুলাই ২০২৬ সালে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এক লাফে এ ওষুধের দাম প্রতি বক্সে ৪০০ টাকা বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। ভোক্তাদের মধ্যে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। এমনকি ফার্মেসিগুলোতে বিক্রেতারা পড়ছেন বিপাকে। ক্রেতাদের কাছে জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে ওষুধের দোকানিদের।
ওষুধ বিক্রেতা মোরশেদ আলম বলেন, শীতকাল এলে এমনিতেই কিছু ওষুধের কৃত্রিম সংকট দেখা দেয়। ইতোমধ্যে এজমা রোগী ও শিশুদের ঠাণ্ডার জন্য ব্যবহূত উইন্ডাল প্লাস প্রতি পিসে ৫ টাকা দাম বাড়িয়ে ৩০ টাকা ও ব্রডিকার্ট ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোনো আগাম নোটিস না দিয়ে প্রায় ২৬টি প্রোডাক্টের দাম বাড়ায় অনেকে ওষুধ কিনতে এসে পড়ছেন বিপাকে। তিনি বলেন, ওষুধের দাম বাড়লেও এগুলো দেখার জন্য কেউ নেই।
জানা গেছে, বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের মাত্র ২ দশমিক ৭৯ শতাংশের দাম সরকারের প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর নির্ধারণ করতে পারে। বাকি ৯৭ ভাগের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো। সরকারের নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, ওষুধের কাঁচামাল, মার্কেটিং খরচ ও ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে ইচ্ছেমতো ওষুধের মূল্য ধরছে। জীবনরক্ষাকারী ওষুধের লাগামহীন দাম রোগীদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধি রোধে উচ্চ-আদালত থেকে নির্দেশনা দেয়া হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না।
জানা গেছে, সরকারের তালিকাভুক্ত ৩১০টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আছে। ওষুধের বাজার প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকার। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ৪১৮০টি জেনেরিকের (৯৭ দশমিক ২১ শতাংশ) ৩৫ হাজার ২৯০টি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করে থাকে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় এসেনসিয়াল ড্রাগ হিসাবে পরিচিত ১১৭টি জেনেরিকের (২ দশমিক ৭৯ শতাংশ) মূল্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। বাকি ৪ হাজার ৬৩টি ব্র্যান্ডের দাম প্রস্তুতকারী কোম্পানি নির্ধারণ করে। কোম্পানিগুলো ভ্যাট প্রদানে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে থাকে।
ওষুধ সেবনের চাহিদা বাড়ায় এ খাতের প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, ‘ওষুধশিল্প খাতের পরিধি ও রোগীদের ওষুধ সেবনের চাহিদা বাড়ায় ২০১৯ সালে করোনা মহামারি শুরুর পর কাঁচামাল আমদানিসহ উৎপাদন খরচ কিছুটা বেড়ে যায়। এই অজুহাতে ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠাগুলোর সংগঠন ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ (বিএপিআই) বিভিন্ন ফোরামে ধারাবাহিকভাবে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করে আসছে। এতে অধিদপ্তর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করছে।
জানা গেছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের যোগসাজশে এপ্রিলে দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বেশকিছু ওষুধ কোম্পানি ৭ থেকে ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বাড়িয়েছে। চলতি বছরের ২৯ এপ্রিল ওষুধের অস্বাভাবিকভাবে দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সব ধরনের ওষুধের দাম বৃদ্ধি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়ে রুল দেন হাইকোর্ট। তবে ওই রিটের বিপক্ষে উচ্চ আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ওষুধ শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ১১ ধারা মতে, সরকার ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা ছিলো কিন্তু ওষুধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ এর ৩০(১) (২) ধারা অনুযায়ী শুধু গেজেটে প্রকাশিত তালিকাভুক্ত ওষুধগুলোর খুচরামূল্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আইনের এমন দুর্বলতার সুযোগে ওষুধ প্রস্তুতকারী
কোম্পানিগুলো তাদের খামখেয়ালি মতো ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। বর্তমানে আমরা ১১৭টি ওষুধের বাইরে বাকি ব্র্যান্ডের দাম নির্ধারণ করতে পারে না। ১৯৯৪ সালে জারিকৃত গেজেট সংশোধন করে ১১৭টি জেনেরিকের পরিবর্তে মোট ওষুধের এক-তৃতীয়াংশ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা প্রণয়ন করা গেলে সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে।
ওষুধ কোম্পানির একাধিক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তাছাড়া লেবেল, কার্টন, মোড়ক সামগ্রী এবং বিপণনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়। যদি পরিবেশ বান্ধব কনটেইনার বা টিনের বাক্সে ওষুধ সরবরাহ করা হতো তাহলে খরচ কমে যাবে।
দুটি বড় ওষুধ কোম্পানির কর্মকর্তা বলেন, তারা প্রতিনিধি বা মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভদের মাধ্যমে ওষুধ মার্কেটিং করে থাকেন। শুধু জেলা বা উপজেলা নয় এমনকি গ্রামের বাজারে পর্যন্ত কোম্পানিগুলোর মার্কেটিং নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। মার্কেটিং জনবলের বেতন-ভাতা, মোটরসাইকেলের জ্বালানি উৎপাদিত ওষুধের দামের সঙ্গে মার্কেটিং খরচ হিসাবে সমন্বয় করা হয়ে থাকে। ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে।
ভোক্তাঅধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, কোম্পানিগুলো চিকিৎসকদের ফ্ল্যাট, গাড়ি, বিদেশ ভ্রমণসহ নানা উপহারসামগ্রী দিয়ে থাকে। যার ব্যয়ভার ভোক্তাকে পরিশোধ করতে হচ্ছে ওষুধ ক্রয়ের মাধ্যমে। উন্নত বিশ্বের মতো ট্রেড নামের পরিবর্তে জেনেরিক নাম (সব কোম্পানির ওষুধের একই নাম হবে) প্রেসক্রিপশনের নিয়ম করা যেতে পারে। এতে অসুস্থ মার্কেটিং প্রতিযোগিতা বন্ধ হবে। তখন দাম অনেকাংশে কমে যাবে। সর্বোপরি ওষুধের মূল্য নির্ধারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের আদলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, বিএপিআই, ক্যাব, বিসিডিএসসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে স্বাধীন কমিশন গঠন করা দরকার।
কেন হঠাৎ করে ওষুধের এমন দাম বেড়ে গেলো জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আসরাফ হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, স্কয়ারের প্রায় ২৬টি ওষুধের দাম বেড়েছে। অন্যান্য কোম্পানিগুলোর চাইতে এতদিন তাদের ওষুধের দাম কম ছিলো। তারা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করে ওষুদের দাম প্রায় ১৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। তাছাড়া দাম বাড়ানোর বিষয়টি অধিদপ্তর একা করে না।
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নীতি-নির্ধারকরা এতে জড়িত। ১৯৯৪ সালের গেজেটের পর অনেক অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ বাজারে এসেছে। এই তালিকা বড় করা গেলে দাম নিয়ন্ত্রণে ওষুধ প্রশাসন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। অধিদপ্তর চায় এসেনসিয়াল ড্রাগের তালিকা বাড়ুক। তবে স্কয়ারের ওষুধের দাম যৌক্তিক বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।