সাবেক গভর্নরের নীতিমালা ছিল ‘চাপানো’
—কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকাদের বৈষম্য সৃষ্টিকারী নীতিমালার আলোকে আজ বুধবার শেষ হতে চলেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) পদের ভাইভা। জানা গেছে, সরকারি ব্যাংকগুলোর পদোন্নতি বৈষম্য বেশ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে যেসব ব্যাংকে দ্রুত পদোন্নতি হয় এবং বিলম্বে পদোন্নতি হয়— সেসব ব্যাংকের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায় নতুন করে সেই পুরোনো নীতিমালায় জিএম পদে পদোন্নতি ব্যাংকারদের কাছে কাটা ঘায়ে নূনের ছিটার মতো কাজ করছে। এতদিন জিএম থেকে তদূর্ধ্ব পদগুলো ভিন্ন ব্যাংক থেকে পূরণ করা হতো। এমন বৈষম্য সৃষ্টিকারী নীতিমালার পরিবর্তন করতে দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছিলেন বিলম্বে পদোন্নতি পাওয়া ব্যাংকের কর্মকর্তারা। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্তৃপক্ষ তাদের দাবির বিষয়ে বরাবরের মতোই উদাসীনতা দেখিয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতি বৈষম্য রোধে চলতি মাসে ২৫৮ কর্মকর্তার জিএম পদের জন্য সাক্ষাৎকারের (আজ শেষ) পর পদোন্নতিপ্রাপ্তদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানে পদায়নের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক অবস্থায় ৯ আগস্ট পদত্যাগ করেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে তিনি তার পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।
এদিকে একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) এবার সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) থেকে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) পদে পদোন্নতির জন্য ২৫৮ জনের প্যানেল চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। গত ৪ নভেম্বর থেকে পদোন্নতির জন্য সাক্ষাৎকার নেয়া শুরু হয় এবং আজ বুধবার তা শেষ হতে যাচ্ছে। যদিও একই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত ১৯৯৮, ২০০০ এবং ২০০৪ ব্যাচের কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়েছে। সেখানে রূপালী ব্যাংকের সর্বাচ্চ ৭১ জন এবং জনতা ব্যাংকের মাত্র ৯ জনকে ভাইভার জন্য ডাকা হয়েছে। এটা অবশ্যই স্পষ্ট বৈষম্য। এমন বৈষ্যমের কারণে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। যদি এবারও রূপালী কিংবা সোনালী ব্যাংকের পদন্নোতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জনতাসহ অন্যান্য ব্যাংকের জিএম পদ পূরণ করা হয়, তবে যেসব ব্যাংকে নিচের দিকে বিলম্বে পদোন্নতি হয়— সেসব ব্যাংক কর্মকর্তার পদোন্নতিজনিত বৈষম্য আরও উস্কে দেবে।
শুধু নীতিমালার ত্রুটির কারণে সমান যোগ্যতা সত্ত্বেও এই ব্যাচের কোনো ব্যাংকের কর্মকর্তা জিএম, ডিএমডি এবং এমডি হবেন। আর নিচের দিকে বিলম্বে পদোন্নতি পাওয়া কিছু ব্যাংকের কর্মকর্তা কখনো জিএম হওয়ার সুযোগই পাবেন না। এমনকি নিচের দিকের পদোন্নতিও বাধাগ্রস্ত হবে, যা নিয়ে পদোন্নতিবঞ্চিত ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা বাড়াবে এবং কাজের পরিবেশও বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
জিএম পদে ভাইভা দেয়া এক ডিজিএম নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, চলতি নভেম্বরে সাক্ষাৎকার শেষে জিএম পদে পদোন্নতিতে জারিকৃত বিদ্যমান নীতিমালা বাস্তবায়িত হলে অনেক যোগ্য, অভিজ্ঞ ও ত্যাগী কর্মকর্তা পদোন্নতি পাবেন না। আবার ব্যাংকভেদে অনেক সহকর্মী পদোন্নতিবঞ্চিত হবেন। ইতোমধ্যে ১৯৯৮ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্রুত পদোন্নতি হওয়ায় একটি ব্যাংক থেকে চারজন এমডি এবং আটজন ডিএমডি হয়েছেন। তাদের অধীনেই ওই ব্যাচের কর্মকর্তাদের কাজ করতে হয়েছে। এবার তো জুনিয়রদের অধীনেই কাজ করতে হবে। এজন্য দায়ী ব্যাংকের পদোন্নতি নীতিমালা, এটি কিন্তু কোনো যোগ্যতার ঘাটতি নয়।
আরেকজন পদোন্নতিপ্রত্যাশী ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, শুধুমাত্র একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এসব আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সে সময় জারি করা নীতিমালার কারণে ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তার মেধা, অভিজ্ঞতা ও জ্যেষ্ঠতার মূল্যায়ন লংঘিত হচ্ছে, যা সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে সংকট সৃষ্টি করবে। আবার অন্য ব্যাংক থেকে পদায়ন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অভিজ্ঞতা না থাকায় কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন হতেও সমস্যা হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, ব্যাংকারদের পক্ষ থেকে সাবেক গভর্নরের নীতিমালাকে ‘চাপানো’ আখ্যায়িত করে বাতিল চেয়ে গভর্নর বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। তাদের দাবি যাচাই-বাছাই এবং পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নীতিমালা অনুযায়ী, সরকারি খাতের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও জিএম পদে পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী একটি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্য ব্যাংকে পদায়নের বিধান রাখা হয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (ব্যাংকিং অনুবিভাগ) বদরে মুনির ফেরদৌস বলেন, জিএম পদে পদোন্নতির বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী সরকারি ব্যাংকের ২৫৮ জনকে ভাইভার জন্য ডাকা হয়েছে। নীতিমালায় পরিবর্তন হলে তাদের পদোন্নতিতে নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে।