রান্নায় চরম ভোগান্তিতে গ্রাহক

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: জানুয়ারি ৬, ২০২৫, ১১:৫৩ পিএম

দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া উচিত— অধ্যাপক এম শামসুল আলম 

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

সাপ্লাই সংকটে ঠিকভাবে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না— কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান 

মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ

দেশে বছরজুড়ে গ্যাস সংকট বিদ্যমান। বাসাবাড়ি, সিএনজি স্টেশন, পেট্রোল পাম্প, শিল্প-কলকারখানা সর্বত্র একই দৃশ্য। শীতকালে এ সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় আবাসিক ও শিল্প খাতের গ্রাহকদের। গ্যাসের খরা কবে কাটবে জানে না সাধারণ মানুষ। সহসা ঘাটতি মোকাবিলাও করতে পারছে না পেট্রোবাংলা— এমনটিই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। 

রাজধানীর কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা হোসনে আরা আমার সংবাদকে জানান, ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত জ্বলে না চুলা। ফলে শীত উপেক্ষা করে গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় রান্নার জন্য। এ জন্য বাধ্য হয়ে বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রিক চুলা কিংবা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছেন অনেকে। এতে লাইনের গ্যাসের বিলের সাথে গুনতে হয় অতিরিক্ত খরচও। 

মুগদা এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা রহিম শেখ বলেন, চুলায় গ্যাস থাকুক আর না থাকুক প্রতিমাসে বিল পরিশোধ করতে হয়। অন্যথায় নাকি লাইন কেটে দেবে তিতাস কর্তৃপক্ষ। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়ার জন্য এত মানুষ জীবন দিলেও সমাজ থেকে অন্যায্য ও অনৈতিকতা বিলুপ্ত হয়নি। দুর্নীতি রয়ে গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। 

ডেমরা এলাকার বাসিন্দা রহমত আলী বলেন, লাইনের গ্যাসের আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের তিনজনের সংসার, রান্না কম, কেরোসিনের স্টোভেই আপাতত রান্না করছি।  

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, কেরানীগঞ্জ, গ্রিনরোড, মহাখালী, আজিমপুর, আদাবর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, মৌচাক, নাজিরাবাজার, মগবাজার, ধলপুর, কাঁঠালবাগান, মিরপুর, মীরবাগ, মধুবাগ, নয়াটোলা ও তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে লাইনের গ্যাসের তীব্র সংকট। এসব এলাকায় দিনের বেলায় রান্না করা দায় হয়ে পড়েছে। যদিও কিছুটা গ্যাস থাকে, তাতে টিমটিম করে চুলা জ্বলায় রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে এসব এলাকার বাসিন্দারা রাতে রান্না করছেন, অনেকে বাড়তি টাকা খরচ করে ব্যবহার করছেন এলপিজি সিলিন্ডার।

পাশাপাশি সিএনজি স্টেশন ও উৎপাদন কারখানায়ও গ্যাসের স্বল্পতা দেখা গেছে। এতে স্টেশনগুলোতে গাড়ির দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। কারখানাগুলোতেও উৎপাদন সীমিত হয়ে পড়েছে। 

শীতে ইউরোপে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই সংকট এড়াতে আগে থেকেই পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করে দেশগুলো। কিন্তু বাংলাদেশে শীতে গ্যাসের চাহিদা না বেড়ে বরং কমে। এরপরও গ্যাসের সংকটে বাসাবাড়িতে রান্নার চুলা জ্বালানো যায় না দিনের বেলায়। শিল্পকারখানাও ধুঁকতে থাকে গ্যাসের সরবরাহ ঘাটতিতে।

তিতাস গ্যাস সূত্র জানায়, দেশে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৪২০ কোটি ঘনফুটের বেশি। দেশে দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে ১১০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এফএসআরইউ আর স্থানীয় উৎপাদন মিলিয়ে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস সরবরাহ করা হতো। 

গত ৩১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ১ জানুয়ারি থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের জন্য মহেশখালীতে থাকা এক্সিলারেট এনার্জি পরিচালিত এলএনজি এফএসআরইউ থেকে মোট ৭২ ঘণ্টা আরএলএনজি সরবরাহ বন্ধ থাকবে। এতে সারা দেশে গ্যাস সরবরাহ সাময়িক হ্রাস ও স্বল্প চাপ বিরাজ করবে।

তারা জানায়, সবমিলিয়ে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে না তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। ফলে গ্যাসের সাপ্লাই কম। আমরা গ্যাস কম পাচ্ছি। এজন্য ঠিকভাবে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। দিনে ১৯৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হলে আমরা ভালোভাবে চলতে পারি, কিন্তু আমাদের দেয়া হচ্ছে ১৫০০ মিলিয়নের মতো। অর্থাৎ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।  

সেখানে বলা হয়, এই সময়কালে অন্য এফএসআরইউ (এমএলএনজি) দিয়ে দৈনিক প্রায় ৫৭০ থেকে ৫৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। এর ফলে বিদ্যুৎ খাতে দৈনিক প্রায় ১৫০ থেকে ১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাবে। 

এছাড়াও অন্য খাতগুলোতে দৈনিক প্রায় ৫০-৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ হ্রাস পাওয়ার কারণে দেশের কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে বলেও জানানো হয়। তবে এফএসআরইউ চালু হলেও পাইপলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে গ্যাস পৌঁছাতে আরও কিছুটা সময় লাগবে এবং সেই সময় পর্যন্ত ভোগান্তি সহসাই কমছে না বলে জানিয়েছে পেট্রোবাংলার একটি সূত্র।

তিতাস গ্যাসের অপারেশন ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান বলেন, সাপ্লাই সংকটে ঠিকভাবে গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। দিনে ১৯৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস হলে আমরা ভালোভাবে চলতে পারি, কিন্তু আমাদের দেয়া হচ্ছে ১৫০০ মিলিয়নের মতো। এ জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, আমদানি-নির্ভরতা থেকে জ্বালানি খাতকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। বিদেশ থেকে আমদানি করা সংকট সমাধানের কোনো পথ নয়। দেশীয় গ্যাস উত্তোলন ও উদ্ভাবনে গুরুত্ব দেয়া উচিত। তিনি বলেন, গ্রাহক ঠিকমতো গ্যাস পাচ্ছে না; কিন্তু প্রতি মাসে বিল দিতে হচ্ছে। এটি অন্যায়।