দেশের ব্যাংক খাত খেলাপি ঋণের কারণে চরম সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পতিত সরকারের সুবিধাভোগী এস আলম, সামিটসহ বড় বড় গ্রুপের শীর্ষ কর্তারা নামে-বেনামে ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের টাকা ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় এই সংকট এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।
ব্যাংক খাতের ওপর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে ইচ্ছেমত আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করে মানুষকে ধোঁকা দেয়া সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তাদের কয়েকজনকে অপসারণের পর দেখা যায়, দেশে এখন খেলাপি ঋণ রেকর্ড প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা ছুঁইছুঁই করছে। তবে এটি ব্যাংক খাতের প্রকৃত চিত্র নয়। গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক দুটি অডিট কোম্পানিকে দায়িত্ব দিয়েছে শরিয়াভিত্তিক ছয়টি ব্যাংক অডিটের জন্য।
অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, বড় গ্রুপগুলোর নেয়া ঋণ তুলতে না পারলে দেশের ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
তারা বলছেন, খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ ব্যাংকে শুধু অডিট পরিচালনা করলেই হবে না, খেলাপি উদ্ধার ও নতুন করে যেন খেলাপি বাড়তে না পারে সেদিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই সংকটের সমাধান না হলে ব্যাংক খাতের জন্য একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি
টাকা। ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। সে হিসাবে এ খাতের বিতরণ করা ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। খেলাপি ঋণ যত বাড়ছে দেশের ব্যাংকগুলোর সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করছে। ব্যাংকগুলো ঋণ দেয়ার মাধ্যমে মুনাফা অর্জন করে। তবে যখন ঋণ আদায় সম্ভব হয়নি, তখন ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যায়। এর ফলে ব্যাংকগুলো ক্ষতির মুখে পড়ে। একইসঙ্গে তাদের আর্থিক সক্ষমতাও কমে যায়।
খেলাপি ঋণ বাড়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেছেন, খেলাপি ঋণ আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। কিন্তু আমরা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এখন খেলাপি ঋণ নিয়ে মাঠে নামছি না। যত খেলাপি ঋণ আছে সব বেড়িয়ে আসুক, এটাই আমরা চাচ্ছি। আগে আমরা খেলাপির পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করতাম, আর এখন আসল চিত্র প্রকাশ করে দিচ্ছি। অডিটের পর খেলাপি ঋণ বেড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা হতে পারে। কোন প্রক্রিয়ায় এটি কমাবো সেটি আমরা তখন সিদ্ধান্ত নেব। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংকগুলোর লুটপাটের তথ্য লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সেই তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। যেভাবে লুটপাটের তথ্য এখন বেরিয়ে আসছে তাতে খেলাপি ঋণের হার আগামী দিনে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
ব্যাংক রক্ষায় আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে— সাবেক সরকারের সুবিধাভোগী এস আলম, বেক্সিমকো, সামিট, ওরিয়ন, নাবিল, নাসা, থার্মেক্স গ্রুপের যেসব সাবেক পরিচালক জালিয়াতি করে ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, তাদের শেয়ার বিক্রি করে ঋণের টাকা সমন্বয় করা; দেশে তাদের থাকা অন্যান্য সম্পদ বিক্রি করে ঋণ আদায়; দেশ থেকে ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করে যেসব সম্পদ গড়েছেন, সেগুলো শনাক্ত করে দেশে ফিরিয়ে আনা।
দেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা আরও বলেন, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ কোন ব্যাংকের মাধ্যমে কত টাকা কোন দেশে পাচার করা হয়েছে সে বিষয়ে স্পষ্টভাবে জানা যাবে। পাচারের টাকা ফেরত আনা একটি সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। নির্ধারিত সংস্থাগুলো বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। নিরাপত্তার স্বার্থেই তারা এই বিষয়গুলো আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া এসব পদক্ষেপে খেলাপি ঋণ আদায় না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এ জন্য ঋণ আদায়ে ভিন্ন পথও পরিকল্পনায় রেখেছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, খেলাপি সাবেক পরিচালকদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নামে দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদ থেকে ঋণের টাকা আদায়ের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। জালিয়াতদের নামে ব্যাংকে থাকা এফডিআর সমন্বয় করা হবে।
এছাড়াও ঋণখেলাপিদের ওপর সামাজিক চাপ সৃষ্টির জন্য তাদের দেশে থাকা কোম্পানির অফিস বা কারখানার সামনে ঋণ আদায়ে সভা-সমাবেশ করা, বাড়ির সামনে অবস্থান বা মানববন্ধন করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে ব্যাংকগুলো।
বর্তমানে দেশের কয়েকটি বড় ব্যাংক খেলাপি ঋণের চাপে অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গভর্নর টাকা ছাপিয়ে সহায়তার নীতি থেকে সরে এসে কয়েকটি ব্যাংককে এরই মধ্যে সহায়তা দিয়েছে। তবে এতে সাময়িক সমস্যার সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান পাওয়া যায়নি। ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের মতো ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে সাপোর্ট দিলে পরিস্থিতি আরও প্রকট হতে পারে এ জন্য একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি আদায় ও নতুন খেলাপি হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে কাজ করতে হবে।