সংকটের মধ্যেই বাড়ছে দাম

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৫, ২০২৫, ১১:৫৩ পিএম
  • চুলায় গ্যাস নেই তবুও গুনতে হবে ১৩৮০ টাকা

অযথা অর্থ নষ্ট না করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে সমস্যা সমাধান করা প্রয়োজন— ম. তামিম জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েট অধ্যাপক

গ্যাস নিশ্চিত না করে দাম বৃদ্ধি করা গ্রাহকদের সাথে ভয়ঙ্কর অন্যায়— এ শামসুল আলম জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও জ্বালানি উপদেষ্টা, ক্যাব

কয়েক বছর ধরেই রাজধানীসহ সারা দেশে গ্যাসের সংকট বিদ্যমান। এতে আবাসিক ও শিল্প খাতে চরম ভোগান্তি পেহাতে হয় গ্রাহকদের। গ্রামে বিকল্প হিসেবে মাটির চুলা থাকলেও শহরে রান্নার কাজ প্রায় শতভাগ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। রাজধানীর প্রায় সব এলাকায় দিনে চুলায় গ্যাস পাওয়া যায় না। কোথাও কোথাও থাকলেও গ্যাসের চাপ কম। তাতে রান্না করা সম্ভব নয়। ফলে গৃহিণীদের গভীর রাতে রান্নার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। যদি একটু গ্যাস পাওয়া যায়। যার ফলে গ্যাস সংকটে

নাগরিক দুর্ভোগ চরমে ঠেকেছে। কিন্তু পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বাড়িয়েই চলছে। হঠাৎ করে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে দেড়গুণ বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে। শিল্প খাতে গ্যাসের দাম আবারও বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। এ যেন ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই, কিল গোঁসাই’ প্রবাদের মতোই ভোক্তাদের সঙ্গে আচরণ করছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)।

রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার কর্মজীবী নারী হুসনে আরা বেগম দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, বহুদিন ধরে গ্যাস সংকট। তাই বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রিক চুলা ও ডিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করছি। অন্যদিকে প্রতি মাসে দুইমুখো চুলার জন্য এক হাজার ৮০ টাকা বিল দিতে হয়। প্রায় বছরখানেক লাইনের গ্যাসে রান্না করতে পারছি না। তবুও নিয়মিত বিল দিতে হয়। এর মধ্যে আবার নাকি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এতে গ্যাস ব্যবহার না করেই আমাকে ১৩৮০ টাকা গুনতে হবে। এই অন্যায় আর সহ্য করতে পারছি না।

মুগদা এলাকার বাসিন্দা নাহিদ হোসেন বলেন, বছরখানেক ধরে গ্যাস সংকট অনেক বেড়েছে। দিনে একটু গ্যাস পাওয়া গেলেও অফিসের কাজের পাশাপাশি বাসায় রান্না করার সময় ঠিকমতো গ্যাস না পাওয়া যায় না। এতে ভয়াবহ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গ্যাসের অভাবে মাঝেমধ্যেই হোটেল থেকে খাবার কিনতে হয়। তিনি আরও বলেন, মিটারবিহীন লাইনে এই এক সমস্যা। মিটার থাকলে যতটুকু ব্যবহার করেছি ততটুকু বিল আসত।

তিতাস গ্যাস সূত্র জানায়, মিটারের গ্রাহকদের তুলনায় মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকরা অনেক বেশি গ্যাস ব্যবহার করছেন। এক চুলা ৫৫ ঘনমিটারের বিল ও দুই চুলা ৬০ ঘনমিটারের বিল আদায় করা হচ্ছে। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে ১০০ ঘনমিটার পর্যন্ত গ্যাস ব্যবহারের রেকর্ড রয়েছে।

নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের সঙ্গে আবাসিকের বিষয়টি থাকছে বলে জানিয়েছেন কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ। তিনি বলেন, প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী ও নন মিটার গ্রাহকের ব্যবহারের মধ্যে অনেক তারতম্য রয়েছে। প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহক অনেকটা মিতব্যয়ী হন। তাই তাদের ব্যবহারের পরিমাণ অনেক কম হয়ে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং বিগত সরকারের আমলে জ্বালানি খাতের দুর্নীতি, লুণ্ঠনের পরিমাণ নিরূপণ করে সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করা দরকার।  
প্রসঙ্গত, গত ৬ জানুয়ারি বিদ্যমান গ্রাহকদের দর অপরিবর্তিত রেখে নতুন শিল্প-কারখানার বয়লার ও শিল্প-কারখানার জেনারেটরে (ক্যাপটিভ) সরবরাহ গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা।

তবে আইনগতভাবে পেট্রোবাংলার দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিবেচনায় নেয়ার সুযোগ নেই। কেবলমাত্র লাইসেন্সি প্রতিষ্ঠান দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিতে পারে। সে কারণে বিতরণে কোম্পানিগুলোর কাছে মূল্য সমন্বয়ের প্রস্তাব চেয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। ৭ জানুয়ারি ইস্যু করা পত্রে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে তিন কর্মদিবসের মধ্যে ট্যারিফ পরিবর্তনের প্রস্তাব কমিশনে দাখিলের জন্য বলা হয়েছে।

এদিকে মিটারবিহীন আবাসিক গ্রাহকের নির্ধারিত পরিমাণ গ্যাসের বিল আদায় করা হয়। গ্রাহক ব্যবহার করুক, না করুক অথবা বেশি ব্যবহার করলেও নির্ধারিত বিলেই তাকে দিতে হয়। বিইআরসি সর্বশেষ গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে ২০২২ সালের মে মাসে। তখন বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রিপেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহকদের পরিসংখ্যানে দেখা যায় গড়ে এক চুলা ৪০ এবং দুই চুলা সর্বোচ্চ ৫০ ঘনমিটার ব্যবহার করছে। প্রিপেইড গ্রাহকের ব্যবহারের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে একমুখো চুলা ৭৩ দশমিক ৪১ ঘনমিটার ও দুইমুখো চুলা ৭৭ দশমিক ৪১ ঘনমিটার থেকে কমিয়ে যথাক্রমে ৫৫ ও ৬০ ঘনমিটার করা হয়।

বিইআরসির আদেশের ১০ মাস পর তিতাস গ্যাস বিদ্যমান এক চুলা ৫৫ ঘনমিটার থেকে বাড়িয়ে ৭৬ দশমিক ৬৫ ঘনমিটার এবং দুইমুখো চুলায় ৬০ ঘনমিটার থেকে বাড়িয়ে ৮৮ দশমিক ৪৪ ঘনমিটার করার আবেদন দিয়েছে। আর পরিমাণ বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই দামও বেড়ে যাবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একমুখো চুলার বিল ৯৯০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১ হাজার ৩৮০ টাকা ও দুইমুখো চুলার বিল এক হাজার ৮০ টাকা থেকে বেড়ে হবে এক হাজার ৫৯২ টাকা। ওই সময় তিতাস তার আবেদনে বলেছিল, মিটারবিহীন কমবেশি ২৫ লাখ গ্রাহকের বিপরীতে কোনো সমীক্ষা বা তথ্য বিশ্লেষণ না করেই ঘনমিটারের পরিমাণ নির্ধারণ করেছে বিইআরসি। এতে কারিগরি ক্ষতি বেড়েছে এবং সরকারি লাভজনক প্রতিষ্ঠান তিতাস আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যদিও সে প্রস্তাব আমলে নেয়নি বিইআরসি।

জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. ম. তামিম জানান, সম্প্রতি গ্যাসের দাম দেড়গুণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকার আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। এরপরও হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কেন নেয়া হচ্ছে এর জবাব নেই। অযথা অর্থ নষ্ট না করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে সমস্যা সমাধন করা প্রয়োজন।

অপর জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম আমার সংবাদকে মুঠোফোনে বলেন, গ্যাস নিশ্চিত না করে দাম বৃদ্ধি করার ফন্দি গ্রাহকদের সাথে ভয়ংকর অন্যায়। নানা লুণ্ঠন নীতির মাধ্যমে জ্বালানি খাতকে শেষ করে দেয়া হচ্ছে। লোকসানের অজুহাতে দাম বাড়ানোর কথা বলা হলে আমি তাদের ব্যয় রিভিউ করতে বলি। অন্যায় ও লুণ্ঠন করে অযৌক্তিক দাম বৃদ্ধি করা হলে তা গ্রাহকের অধিকার খর্ব হবে। তা জ্বালানি সুবিচার না করে অবিচারের শামিল হবে।