চট্টগ্রামভিত্তিক বিতর্কিত ব্যবসায়ী গ্রুপ এস আলমকে গ্রাহকের আমানত লুটপাটের সুযোগ দেয়া ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির (আইবিবিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুনিরুল মওলা এখনও বহালতবিয়তে। ইসলামী ব্যাংক চলছে তারই পরিচালিত আইনে। হাস্যরস করে কেউ তাকে মওলা তন্ত্র বলেও আখ্যা দিয়েছেন। আইন লঙ্ঘন করে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স কিনে তা বেনামি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের কাজে ব্যবহারের বন্দোবস্ত করে দিতেন তিনি। একের পর এক বেনামি ঋণ, ব্যাংকের শাখাগুলো থেকে ঋণপ্রাপ্তিতে সীমা লঙ্ঘন করে এস আলমকে সুযোগ দেয়াসহ বহু আর্থিক কেলেংকারীর হোতা মুনিরুল মওলার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। ইতোমধ্যে এস আলমের মালিকানায় থাকা ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া হয়। পদত্যাগে বাধ্য হন ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান ও এমডিরা। তবে অজ্ঞাত কারণে দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেয়া হলেও এমডি হিসেবে থেকে যান মুনিরুল মওলা। এখানেই শেষ নয়, গ্রাহকের আমানত লুটপাটের সহযোগী ইসলামী ব্যাংকের এই এমডিকে নিয়ে বর্তমান গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকের শাখাও উদ্বোধন করেছেন। এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত অনান্য ব্যাংকে আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অডিট করা হলেও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়া ইসলামী ব্যাংকে কোনো অডিট করা হচ্ছে না। এক সময়ের দেশের সবচেয়ে ভালো ব্যাংকটি এখনো মুর্মূষু অবস্থা থেকে দাঁড়াতে পারেনি। চরম সমালোচিত সেই এমডিকে পদে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারদেনা করে এখনো চলছে এক সময়ের শক্তিশালী ব্যাংকটি।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুনিরুল মওলা ও সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মিফতাহ উদ্দিনসহ ব্যাংকটির কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ডলার ক্রয় করে ওই অর্থ দেশের ব্যাংকগুলো থেকে নেয়া বেনামি ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতেন। তথ্য বলছে, এস আলম ও তার সহযোগীরা বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে হুন্ডির রমরমা ব্যবসা করেছেন। ওই চক্রের একটি দল প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা কিনে নিত। আর বাংলাদেশে থাকা চক্রের সদস্যরা প্রবাসীর পরিবারকে টাকা পরিশোধ করতেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ ও চলতি হিসাব থেকে টাকা তুলে নিয়ে ওইসব টাকা দিতেন এস আলম।
পর্যবেক্ষণ বলছে, আইন লঙ্ঘন করে এস আলম গ্রুপকে এ অপকর্মের সুযোগ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা। সেখানে গ্রাহক হিসেবে দেখানো হয়েছে, ফেমাস ট্রেডিং করপোরেশন, রেইনবো করপোরেশন, আনসার এন্টারপ্রাইজ, গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশন ও সোনালী ট্রেডার্সকে। তবে ওই লেনদেনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার প্রকৃতির সঙ্গে কোনোভাবেই সংগতিপূর্ণ ছিল না। প্রতিষ্ঠানগুলোর চলতি হিসাবে ‘বিভিন্নভাবে’ আসা অর্থ তুলে নেয়া ও উত্তোলনকারীদের আচরণ ছিল সন্দেহজনক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৪ সালে (জানুয়ারি-আগস্ট) আট মাসে উত্তোলন করা হয়েছে ১ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধুমাত্র খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারী বা প্রতিনিধির মাধ্যমে তুলে নেয়া হয়। আর ২৫৪ কোটি টাকা ‘আন্তঃব্যাংক ক্রেডিট অ্যাডভাইসের (আইবিসিএ) মাধ্যমে অন্যান্য শাখায় স্থানান্তর ও রূপান্তর করে নগদে তুলে নেয়া হয়। ২৫০ কোটি টাকা ব্যবহার হয় দায়দেনা পরিশোধে। এছাড়া ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের নামে তুলে নেয়া হয় ৩ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা। এমনকি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা কর্মীর নামেও তুলে নেয়া হয়েছে ৫ কোটি টাকা।
পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন বলছে, পাঁচ গ্রাহকের চলতি হিসাবে টাকা জমা হতো ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখা থেকে ঋণ নেয়ার মাধ্যমে। ২০২৩ সালের জুন থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ব্যাংকের ১১টি শাখা বা উপশাখা থেকে ইস্যু করা ৮৩টি আইবিসিএর মাধ্যমে খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে মোট ৩৩৪ কোটি টাকা নগদে তুলে নেয়া হয়েছে। তাদের (পাঁচ প্রতিষ্ঠান) চলতি হিসাবে শাখা-উপশাখা থেকে টাকা জমা করে আইবিসিএ ইস্যু করা হয়েছে। শাখার সরবরাহকৃত তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব আইবিসিএর মাধ্যমে বিকাশ এজেন্ট ও মানি চেঞ্জার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এস আলম গ্রুপ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। তারা ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা ব্যবসার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং অজ্ঞাত ব্যক্তিদের নামে অর্থ পাঠিয়ে তা নগদায়ন করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী বা গৃহিণীর হিসাবেও টাকা পাঠিয়ে নগদায়ন করা হয়েছে। তথ্য বলছে, কখনো দিনের শুরুতে তোলা অর্থ দিন শেষে সংশ্লিষ্ট হিসাবগুলোর স্থিতি দ্বারা সমন্বয় করা না গেলে বাকি অর্থ সংশ্লিষ্ট শাখার সাসপেন্স হিসাব (অস্থায়ী বা অশ্রেণিবদ্ধ তহবিল থাকে এমন হিসাব) থেকে নিয়ে সমন্বয় করা হতো।
২০২২-এর অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট ৪৩টি এন্ট্রির মাধ্যমে খাতুনগঞ্জ শাখার সাসপেন্স অ্যাকাউন্ট থেকে ৪৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা নগদ তোলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন সময় সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত খাতুনগঞ্জ শাখার সাসপেন্স অ্যাকাউন্টে ১৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা সমন্বয়হীন ছিল। এসব কর্মকাণ্ডের সময় শাখা প্রধান ছিলেন মোহাম্মদ ইহসানুল ইসলাম ও মুহাম্মদ সিরাজুল কবির। এ বিষয়ে মোহাম্মদ ইহসানুল ইসলাম জানান, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মুনিরুল মাওলা এবং তৎকালীন ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিনের নির্দেশে শাখার সাসপেন্স হিসাব থেকে নগদ নিতেন এবং দিতেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনে দেখা যায়, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার এস এম জামাল উদ্দীন রাসেলের (বর্তমানে মানিকগঞ্জ শাখায় কর্মরত) নামে খাতুনগঞ্জ শাখার পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠানো ৩০ কোটি ৮১ লাখ টাকা ইসলামী ব্যাংকের লোকাল ও গুলশান সার্কেল-১ শাখা থেকে তুলে নেন। আর ইউনিয়ন ব্যাংকের গুলশান শাখার ক্যাশ অফিসার মোহাম্মদ আলী ওই পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠানো ৭৩ কোটি টাকা ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস ও পল্টন শাখা থেকে তুলে নেন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা নর্থ জোন অফিসের এফএভিপি তাহেরুল আমিন পাঁচ প্রতিষ্ঠান থেকে পাঠানো ২৩ কোটি টাকা লোকাল অফিস থেকে তুলে নেন।
এ বিষয়ে তাহেরুল আমিন জানান, ইসলামী ব্যাংকের তৎকালীন ডিএমডি আকিজ উদ্দিনের নির্দেশে তিনি এসব অর্থ তুলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার এস এম জামাল উদ্দীনকে (রাসেল) দিয়েছেন। এছাড়া ইসলামী ব্যাংকের ট্রেনিং একাডেমিতে কর্মরত মেসেঞ্জার কাম গার্ড ওসমান গনি ইসলামী ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে পাঁচ কোটি টাকা নগদে তুলে নেন। এ বিষয়ে ওসমান গনি বলেন, ‘তৎকালীন ডিএমডি আকিজ উদ্দিনের নির্দেশে তিনি টাকাগুলো উঠিয়ে ফের আকিজ উদ্দিনের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।’
পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল ফেমাস ট্রেডিং এবং রেইনবো করপোরেশনের হিসাবে জমা হওয়া টাকার মধ্য থেকে ১০ কোটি টাকা ঢাকার গুলশান সার্কেল-১ শাখা থেকে চার ব্যক্তি তুলে নেন। এদের মধ্যে দুজন গৃহিণী। তারা হলেন- শামীমা আকতার রিমি ও আয়েশা আকতার। আর মিজানুর রহমান ও সৈয়দ মারুফ উর রহমান পেশায় ছাত্র। তারা সবাই আড়াই কোটি টাকা করে তুলে নিয়েছেন। তৎকালীন গুলশান সার্কেল-১ শাখার ব্যবস্থাপক এএসএম নাসির উদ্দিন ফাহিমের নির্দেশে শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা শুধু এনআইডির তথ্যের ভিত্তিতে শাখায় জুনিয়র অফিসার বোরহান উদ্দিনের মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করে ২০টি এমটিডিআর হিসাব খোলেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিরুল মাওলা শাখার জিবি ইনচার্জ এবং শাখা ব্যবস্থাপককে টেলিফোন হিসাব খোলা ও নগদায়ন করা, হিসাবগ্রহীতার প্রতিনিধির কাছে পে-অর্ডার প্রদান করার নির্দেশ দেন। এসব টাকা তোলার সময়ও হিসাবগ্রহীতা সশরীরে শাখায় উপস্থিত ছিলেন না। শাখায় আবুল কালাম নামে একজন ব্যক্তির অথরাইজ লেটারের মাধ্যমে এসব টাকা তোলা হয়। শুধু তাই নয়, এনআইডি, বিদ্যুৎ বিল ও অন্যান্য দলিলাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এসব গ্রাহক প্রত্যেকেই কক্সবাজার সদর এলাকার বাসিন্দা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখার ওই পাঁচ গ্রাহকের প্রায় সবগুলো লেনদেন ছিল সন্দেহজনক। এই প্রতিষ্ঠানের সব কার্যকলাপ অসংগতিপূর্ণ। ব্যাংকিং নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ করে দেয়ায় ইসলামী ব্যাংকের পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শন দল। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর অসংগতিপূর্ণ বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা উত্তোলন, নামে-বেনামে আইবিসিএ ইস্যুর মাধ্যমে টাকা স্থানান্তর, ইস্যুকৃত আইবিসিএর টাকা দিয়ে বেনামে এমটিডিআর হিসাব খোলার সঙ্গে এসব কর্মকর্তা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। এজন্য তৎকালীন ডিএমডি আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিন, খাতুনগঞ্জ শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইহসানুল ইসলাম ও মুহাম্মদ সিরাজুল কবির, গুলশান সার্কেল-১ শাখার তৎকালীন ব্যবস্থাপক এএসএম নাসির উদ্দিনের (ফাহিম) বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কার্যকরে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে। এসব অনিয়মের সঙ্গে ইসলামী ব্যাংকের আলোচিত-সমালোচিত এই এমডি মুনিরুল মওলারও সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনিরুল মওলার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।
মুনিরুল মওলার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো জবাব দেননি।