বিশেষ সাক্ষাৎকার

বাংলাদেশি আমেরিকান উদ্যোক্তার স্মার্ট মিটারে চলে বিশ্বের ৮ দেশ

আমার সংবাদ ডেস্ক প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৮, ২০২৫, ১২:০২ এএম
  • বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াট, উৎপাদন মাত্র ১২ মেগাওয়াট 
  • ডিজিটালের নামে নিজের লোকদের দিয়ে লুটপাট করছেন বিপু ও সাঙ্গোপাঙ্গরা
  • বাংলাদেশসহ বিশ্বের আট দেশে অফিস রয়েছে স্মার্ট মিটারিংয়ের

কনকনে শীতের হাওয়া, এর মধ্যেই উষ্ণতা ছড়িয়ে আগমনের বার্তা দিচ্ছে গ্রীষ্ম। আর গ্রীষ্মকাল মানেই বাংলাদেশের চেনারূপ হঠাৎ বিদ্যুৎ নেই, লোডশেডিং, ভ্যাপসা গরমে জনজীবনে নেমে আসা চরম দুর্ভোগ। এসব প্রতিবন্ধকতাকে দূর করে দেশের বিদ্যুৎ খাতকে অটোমেশনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশি আমেরিকান বিদ্যুৎ ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জন সাখাওয়াত চৌধুরী। 

আমার সংবাদকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার আনোয়ার হোসাইন সোহেল।

দেশের বিদ্যুৎ খাত নানা সংকটে জর্জরিত, যেখানে আর্থিক ক্ষতি, কর্পোরেট স্বার্থ এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা একত্রে সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। জন সাখাওয়াত চৌধুরীর এনকেসফট কর্পোরেশন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি বিকাশের জন্য দুটি স্থানীয় কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডব্লিউজেডপিডিসি)-এর সঙ্গে কাজ করছেন। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নত বিশ্বে ক্যারিয়ার তৈরিতে সহায়তা করছেন।  

মাত্র ২৫ হাজার ডলার নিয়ে যাত্রা করেছিল জন সাখাওয়াত চৌধুরীর কোম্পানি এনকেসফট কর্পোরেশন। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮টি দেশে অফিস এবং ১৪টি দেশে প্রতিনিধি নিয়ে কোম্পানিটি এ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ১৩০০ বেশি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছেন। কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জন সাখাওয়াত চৌধুরী। তার কোম্পানির মোট সম্পদ এখন প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে বিদ্যুৎ অটোমেশনের অভিজ্ঞতা রয়েছে চট্টগ্রামে জন্ম নেয়া এই উদ্যোক্তার।

জন সাখাওয়াত চৌধুরী স্মার্ট গ্রিড ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তার অভিজ্ঞতা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যুৎ খাতের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে কাজ করছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনার ও সম্মেলনে তার অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। তার উদ্ভাবনী চিন্তা এবং নেতৃত্বে  এনকেসফট বিশ্বের শীর্ষ ২০টি প্রযুক্তি সেবাদাতা কোম্পানির একটিতে পরিণত হয়েছে। 

বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ও বাস্তব চিত্র : সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াট হলেও প্রয়োজন মাত্র ১৪ থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট। তবুও বাস্তবে ১২ থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে দেশে লোডশেডিং নিত্যদিনের চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। জন সাখাওয়াত চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের বিদ্যুৎ চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের সক্ষমতা যথেষ্ট; কিন্তু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার অভাবে সংকট কাটছে না।’ তিনি আরও বলেন, জ্বালানি সরবরাহের ব্যর্থতা, পাওনা অর্থ পরিশোধে অক্ষমতা এবং ক্যাপাসিটি চার্জের মতো অব্যবস্থাপনা এই সংকটের মূল কারণ। ‘জনগণের অর্থ দিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করেও তারা বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। এটি একটি জাতীয় ব্যর্থতা,’ বলেন তিনি।

আদানি চুক্তির একপাক্ষিকতা

ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি নিয়ে জন সাখাওয়াত চৌধুরী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেন, ‘এই চুক্তিতে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেক বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে, যা জনগণের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।’ তার মতে, চুক্তির শর্তগুলো পুনর্বিবেচনা করা এবং আরও স্বচ্ছতার সাথে ন্যায্য চুক্তি করার প্রয়োজন। এছাড়া তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্থানীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহারের ওপর জোর দেন।

স্মার্ট মিটারের সমস্যাগুলো

জন সাখাওয়াত চৌধুরী স্মার্ট মিটারিং প্রকল্পের ব্যর্থতাগুলোও তুলে ধরেন। গ্রাহকরা অভিযোগ করেছেন, লোডের সময় প্রদত্ত অর্থের চেয়ে কম ইউনিট বিদ্যুৎ পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘স্মার্ট মিটারের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে কারচুপি হচ্ছে। এটি প্রযুক্তিগত ত্রুটি বা ইচ্ছাকৃত অপব্যবহারের ফল।’ তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, স্মার্ট মিটারগুলোর নিরপেক্ষ তদন্ত এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে। তিনি বলেন, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও তার সহযোগিতার মাধ্যমে বিদ্যুৎ জ্বালানিতে ডিজিটাল করার নামে বেপরোয়া লুটপাট চালিয়েছেন। যার সফলের পরিবর্তে দেশের মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে। 

সোলার পাওয়ার এবং টেকসই সমাধান ; জন চৌধুরীর মতে, সোলার পাওয়ার বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকার ছাদগুলোতে সোলার প্যানেল স্থাপনের মাধ্যমে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব বলেও উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘সোলার পাওয়ার গ্রিডে সংযুক্ত হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমবে এবং এটি দীর্ঘমেয়াদে সাশ্রয়ী হবে। তবে এজন্য আধুনিক ব্যাটারি স্টোরেজ প্রযুক্তি ও সঠিক ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন।’

স্মার্ট মিটারিং ও প্রণোদনা : জন সাখাওয়াত চৌধুরী বিদ্যুৎ ব্যবহারে গ্রাহকদের সাশ্রয়ী করতে স্মার্ট মিটারিং পদ্ধতির উন্নয়ন এবং প্রণোদনার প্রস্তাব দেন। স্মার্ট টেকনোলজির মাধ্যমে পিক-আওয়ার এবং অফ-পিক আওয়ার অনুযায়ী বিদ্যুৎ খরচের পার্থক্য তৈরি করা গেলে গ্রাহকরা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে উৎসাহিত হবেন। 
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও উদাহরণ : বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার গুরুত্বও তুলে ধরেন তিনি। সোলার পাওয়ার ও স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থাপনায় উন্নত দেশের প্রযুক্তি ও কৌশল থেকে শিক্ষা নেয়ার আহ্বান জানান।

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানের উপায় : জন সাখাওয়াত চৌধুরী বিদ্যুৎ সংকট সমাধানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দেন:

১. বিদ্যুৎ খাতে সুশাসন ও দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।

২. ক্যাপাসিটি চার্জের মতো অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বন্ধ করা।

৩. সোলার পাওয়ার এবং অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো।

৪. স্মার্ট মিটারিং ও ব্যাটারি স্টোরেজ প্রযুক্তি উন্নত করা।

৫. আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি করা।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : জন সাখাওয়াত চৌধুরী তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বলেন, ‘আমরা বিদ্যুৎ খাতকে একটি টেকসই ও গ্রাহককেন্দ্রিক খাতে রূপান্তর করতে চাই। এজন্য এনকেসফটের পক্ষ থেকে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং উন্নত সেবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। যার মাধ্যমে গ্রাহক ঘরে বসেই তার বিদ্যুতের যাবতীয় বিষয়ে জানতে পারবেন। এজন্য আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য রয়েছে। যেমন : 

প্রযুক্তি উদ্ভাবন : এমন স্মার্ট গ্রিড সিস্টেম তৈরি করা, যা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ এবং স্থিতিশীল করবে। 

সোলার ইনিশিয়েটিভ : দেশে বড় পরিসরে সোলার পাওয়ার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।

পরিবেশবান্ধব প্রকল্প : কার্বন নিঃসরণ কমাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো।

গ্রাহক সেবা উন্নয়ন : বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ ও ব্যবহারে স্বচ্ছতা ও সাশ্রয় নিশ্চিত করতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু করা।

 তিনি আরও বলেন, ‘বিদ্যুৎ খাতে সঠিক প্রযুক্তি এবং পরিকল্পনার মাধ্যমে শুধু দেশের চাহিদাই মেটানো সম্ভব নয়, বরং আমরা ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ রপ্তানির ক্ষেত্রেও উদ্যোগী হতে পারি। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।’

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

বিদ্যুৎ খাতে সঠিক পরিকল্পনা, জবাবদিহিতা এবং সুশাসন ছাড়া সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। কোটি টাকা খরচ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কনসার্ট করলেই হবে না। মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে হবে। জন চৌধুরীর দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের পাশাপাশি আগামীতে বাংলাদেশ থেকে অন্যান্য দেশে বিদ্যুৎ রপ্তানি করা সম্ভব বলেও মনে করেন উদ্যোক্তা।