সব শ্রেণির শিক্ষার্থীর কাছে সব বিষয়ের বই কবে পৌঁছাবে এমন প্রশ্ন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের। এ প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, আসছে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সব বিষয়ে বই পৌঁছে দেয়া হবে। তবে এর আগেই বই পেতে পারে শিক্ষার্থীরা।
আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে শতভাগ বই পৌঁছে দেয়ার টার্গেট রয়েছে এনসিটিবির। ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বই বিতরণ কার্যক্রম শেষ করতে না পারলে সেটি সর্বোচ্চ ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়াতে পারে। অর্থাৎ আগামী মাসের মধ্যেই শতভাগ বই পাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। গতকাল দৈনিক আমার সংবাদের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এমন ধারণা দিয়েছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বছরের প্রথম দিন উৎসব আয়োজন করে বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করা হতো। এবার বই উৎসব নামে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়নি। সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে জানানো হয়, উৎসব আয়োজন করে সরকারি অর্থ অপচয় করতে চায়নি সরকার। অহেতুক সরকারি অর্থ ব্যয় থেকে বিরত থাকতেই বই উৎসব নামে সব ধরনের আয়োজন বাতিল করা হয়। কিন্তু ১ জানুয়ারিই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয় সরকার। তবে বই ছাপানোর দায়িত্বে থাকা মুদ্রণ শিল্প-মালিকরা চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব বই ছাপাতে ব্যর্থ হওয়ায় টার্গেট অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের কাছে বই পৌঁছায়নি। সব ছাপা হয়নি, যথাসময়ে বই পাচ্ছেন না এমন খবরের সঙ্গে কিছু গুজবও জুড়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটি অংশ। এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সরকারি বই ছাপানোর দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান এনসিটিবি বলছে, জানুয়ারির এক তারিখে সব শিক্ষার্থীর কাছে সব বই পৌঁছে দেয়ার কোনো ইতিহাস নেই।
চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান আমার সংবাদকে জানিয়েছেন, এ বছর ৪০ কোটি বেশি বই ছাপানোর কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে। এর অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ২২ কোটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছেছে। অর্থাৎ ৫৫ শতাংশ বই শিক্ষার্থীরা পেয়েছে। বাকি বই ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পাবে।
তিনি জানান, গত বছরও (২০২৪ সাল) সব শিক্ষার্থীর হাতে বই পৌঁছে ৭ মার্চ। এবার কিন্তু মার্চ পর্যন্ত যেতে হচ্ছে না। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে ১৭ মার্চ। ২০২২ সালে শিক্ষার্থীরা বই পেয়েছে ২৪ মার্চ। ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীরা বই পেতে প্রায় চার মাস সময় লেখেছে। ওই বছর শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে ২৭ এপ্রিল। ২০১৮ সালের ১৩ মার্চ শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে। ২০১৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সব বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। ২০১৬ সালে শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে ২২ মার্চ। ২০১০ সালে ২১ জুলাই অর্থাৎ বই পেতে প্রায় সাত মাস লেগেছে এবং ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের প্রথম বছর শিক্ষার্থীরা সব বই পেয়েছে ২৬ সেপ্টেম্বর, অর্থাৎ ৯ মাস সময় লেগেছে বই পেতে।
এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানান, অন্য বছরের চাইতে এ বছর বই ছাপানোর কাজ অনেকটাই ভিন্ন প্রক্রিয়ায় হয়েছে। এ বছরের বই ছাপানোর জন্য গত বছরের শুরুতেই টেন্ডার দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সেই টেন্ডার বাতিল করা হয়েছে। কারণ, জুলাই বিপ্লবের পর পাঠ্যবইয়ে পরিমার্জন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। বিল্পবের ইতিহাস বইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে বেশ কিছু সময় ব্যয় হয়। আগের বছরে বই পরিমার্জনের কোনো কাজ ছিল না। পূর্বেই বই প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার পরিমার্জন করতে বেশি সময় লেগেছে। এরপর টেন্ডার আহ্বান করা হয়। টেন্ডারেও পরিবর্তন আনা হয়েছে, ব্যয়ও বেড়েছে। এই বর্ধিত ব্যয় নির্ধারণ ও পাস হতেও সময় লেগেছে। অন্য বছরের চাইতে এবার ৫২৩ কোটি বই বেশি প্রকাশ করতে হচ্ছে। ব্যয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এটি একটি বড় কারণ। সব সামলিয়ে টেন্ডার চূড়ান্ত করতে নভেম্বর-২০২৪-এ গিয়ে ঠেকেছে। নভেম্বরে টেন্ডার চূড়ান্ত হলে ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু মুদ্রণ শিল্প-মালিক সমিতি আমাদের আশ্বস্ত করেছিল তারা এক মাসের মধ্যে সব বই ছাপিয়ে দেবে এবং এমন সক্ষমতা তাদের রয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল তারা যা বলেছে, বাস্তবে তা করতে পারেনি। ১১৬টি প্রতিষ্ঠানকে এই ৪০ কোটি বই ছাপাতে দেয়া হয়। তারা যৌথভাবে দৈনিক গড়ে এক কোটি ৪২ লাখ বই ছাপিয়ে দেয়ার আশ্বাস দেয়। সে অনুযায়ী মাত্র ২৮ দিনেই সব বই ছাপার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু তারা সক্ষমতা নিয়ে যে তথ্য দিয়েছে বাস্তবে তারা তা করে দেখাতে পারেনি। তারা গড়ে বই ছাপতে পারছে মাত্র ৪০ লাখ। অর্থাৎ দৈনিক ছাপার ঘাটতি থাকছে এক কোটি দুই লাখ।
এনসিটিবির অভিযোগ, মুদ্রণ শিল্প-মালিকরা সব সেকশন থেকে ব্যবসা করতে চাচ্ছে। তারা চুক্তি অনুযায়ী কাগজ না দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে কাগজ দিয়ে ব্যবসা করতে চায়। কমদামি কালি, চুক্তির চেয়ে কমদামি আর্ট কার্ড এবং বাইন্ডিংয়ের কাজে ব্যবহূত আঠাও কম মূল্যের দেয়ার চেষ্টা করেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরকার। এনসিটিবির চেয়ারম্যান জানান, দ্রুত বই পাওয়ার জন্য এনসিটিবি মুদ্রণ শিল্প-মালিকদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে।
ভোলা জেলার লালমোহন উপজেলার পূর্ব গাইমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোহাম্মদ শফিউল্লাহ আমার সাংবাদকে জানিয়েছেন, তার স্কুলের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির সব শিক্ষার্থীরা সব বিষয়ে বই পেয়েছে। কিন্তু চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ৫০ শতাংশ বই পেয়েছে। বাকি বইও দ্রুত পেয়ে যাবেন বলে জানান শিক্ষা কর্মকর্তারা।
সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে দেয়ার বই ছাপাতে ঠিক আর কতদিন লাগতে পারে এমন তথ্য জানতে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির চেয়ারম্যান মো. রাব্বানী জব্বার ও সাধারণ সম্পাদক মো. কাউসার-উজ-জামান রুবেলের সঙ্গে তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও কথা বলা যায়নি। ফলে ছাপাখানার তথ্য পাওয়া যায়নি।