ঋণের দুষ্টচক্রে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: জানুয়ারি ৩০, ২০২৫, ১২:২৭ এএম

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক ধরনের ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি খাত মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে, যার জন্য মূলত বিগত সরকারের নীতিকাঠামো দায়ী। এই সংকট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক ধরনের ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ২১ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বকেয়া প্রায় ৮৪৫ মিলিয়ন ডলার বা ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি আইপিপি এবং সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের কারণে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত পেট্রোবাংলার পাওনা মোট ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

গতকাল সিপিডি আয়োজিত এক আলোচনায় নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় এ মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।

প্রবন্ধ উপস্থাপনের সময় ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাংলাদেশের জ্বালানি খাত মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে, যার জন্য মূলত পূর্ববর্তী সরকারের নীতিকাঠামো দায়ী। এই সংকট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে শুরু করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত এক ধরনের ঋণের দুষ্টচক্রে আটকে পড়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) ২১ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বকেয়া প্রায় ৮৪৫ মিলিয়ন ডলার বা ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি আইপিপি এবং সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের কারণে মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত পেট্রোবাংলার পাওনা মোট ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।

তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলএনজি আমদানির জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর কাছে মোট ৭২২ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৮ হাজার ৬৬৪ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে পেট্রোবাংলার। অন্যদিকে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরবরাহ করা গ্যাসের জন্য শেভরন বাংলাদেশের কাছে ২২২.৫৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ২ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এদিকে পেট্রোবাংলার কাছে ৩৫ হাজার ৮৬২ কোটি টাকার ভ্যাট বকেয়া রয়েছে এনবিআরের।

সিপিডি তাদের প্রবন্ধে বলেছে, ২০২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর্যায়ক্রমিক বন্ধের ফলে এমনটা হয়েছে। গত ছয় মাসে নতুন কোনো জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হয়নি। জ্বালানি মিশ্রণে গ্যাস বা এলএনজি ৪৩ শতাংশ শেয়ার নিয়ে প্রধান অবস্থানে রয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির অবদান এখনও নগণ্য, ৪ শতাংশ। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সংযোজনের অগ্রগতি তেমন হয়নি।

সিপিডি বলছে, সরকার ঘোষণা করেছে যে সরকার নয়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) জনশুনানির মাধ্যমে তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করবে। তবে এখনো জ্বালানি তেলের মূল্য সরকার নির্ধারণ করছে, যা আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের প্রতিফলন করে না। দুর্ভাগ্যবশত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখনো টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃপক্ষ সংস্কারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৫টি গ্যাস কূপখননের পরিকল্পনা রয়েছে। যার মধ্যে ১০টি কূপ ভাড়া করা রিগের মাধ্যমে খনন করা হবে এবং বাকিগুলো উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া হবে। এখন পর্যন্ত মাত্র একটি কূপ খনন শুরু হয়েছে এবং আরেকটি কূপের জন্য জরিপ চলছে।

অপরদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএনজি আমদানির এবং পুনরায় স্পট এলএনজি আমদানি অনুমোদন দিয়েছে। প্রায় দুই ডজন প্রতিষ্ঠানকে এলএনজি সরবরাহের অনুমোদন দেয়া হয়েছে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির জন্য। একইসঙ্গে সরকার ৩৭টি সোলার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এলওআই বাতিল করেছে। এ ধরনের উদ্যোগ সরকারের আমদানি খরচ কমানো এবং দেশীয় সম্পদ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সংঘর্ষপূর্ণ বলেও মনে করে সিপিডি।

ফাহমিদা বলেন, সিপিডি’র পর্যবেক্ষণে পেঁয়াজ, আলু, বেগুন, ডিম, রুই মাছ, হলুদ, গম, মসুর ডাল, চিনি, গরুর মাংস, রসুন, আদা, সয়াবিন তেল এবং পাম তেলসহ ১৪টি বিভিন্ন প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের সরবরাহ শৃঙ্খল বিশ্লেষণে দামের ওঠানামা এবং অদক্ষতার জন্য বেশ কিছু বাধা দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে, প্রাথমিক বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে মজুদদারি, কমিশন এজেন্ট বা গুদাম পরিচালনাকারীদের আধিপত্য, অপর্যাপ্ত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি পদ্ধতি, উচ্চ উপকরণ খরচ, নিম্নমানের সংরক্ষণ এবং পরিবহন সুবিধা এবং সামগ্রিক সরবরাহকে প্রভাবিত করে এমন অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া। 

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, চালের বাজার ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত জটিল। সে কারণে সিপিডি চালের সরবরাহ শৃঙ্খলে বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা নিরূপণের জন্য মাঠ পর্যায়ে একটি অনুসন্ধানমূলক জরিপ পরিচালনা করে, বিশেষ করে মাঝারি-পাইজাম চাল। যার লক্ষ্য ছিল প্রধানত দামের যে অস্থিরতা তার মূল কারণগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরি করা। 

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, চাল সরবরাহ ব্যবস্থায় অসংখ্য বাজার এজেন্ট রয়েছে। বাজার মূল্যের ওপর গুদাম মালিকদের বা অটো রাইস মিলারদের উল্লেখযোগ্য আধিপত্য লক্ষ্য করা যায়। ফলস্বরূপ ধান চাষিরা প্রায়শই সঠিক দাম পান না। কিন্তু ভোক্তারা অযৌক্তিকভাবে উচ্চ মূল্যের সম্মুখীন হন, যার ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। 

খাদ্য মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, বাংলাদেশে পূর্ববর্তী কর্তৃত্ববাদী সরকার উচ্চ মূল্যস্ফীতির মাধ্যমে একটি অকার্যকর অর্থনীতি রেখে গেছে, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ঠিক করতে হবে। বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলের বিশ্লেষণে মধ্যস্থতাকারীদের একটি জটিল নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা অতিরিক্ত দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ শৃঙ্খলে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে সাহসী এবং জরুরি পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে মূল্যস্ফীতির হার কমানো কঠিন হবে।

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ৪৫.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন : রাজস্ব প্রসঙ্গে সিপিডি বলছে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে ২০২৫ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৩.৭ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময় ছিল ১৭.৭ শতাংশ অর্থাৎ এখানে উল্লেখযোগ্য অবনতি দেখা গেয়েছে। ২০২৫ অর্থবছরের মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অর্থবছরের বাকি সময় ৪৫.১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, যা মোটেই বাস্তবসম্মত নয়। সামগ্রিকভাবে কর রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধি ছিল ঋণাত্মক। কর রাজস্বের দুটি উৎসেই (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড নিয়ন্ত্রিত ও বহির্ভূত) একই চিত্র দেখা গেছে। 

তিনি বলেন, ওই সময়ে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক আহরণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। জুলাই-আগস্টের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে শ্লথগতি এর বড় কারণ। কর রাজস্ব আহরণের পরিস্থিতি বহুলাংশেই সরকারকে মূসক এবং সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধিতে ধাবিত করেছে। তবে আইএমএফের শর্তপূরণের চাপও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। বর্তমান উচ্চ-মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতিতে এ ধরনের উদ্যোগ মোটেই কাম্য নয়। কারণ পরোক্ষ কর সব ধরনের আয়ের মানুষের জীবনেই প্রভাব ফেলে।

বাজেট বাস্তবায়নের হার নিম্নগতি : অন্যদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে ২০২৫ অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত মোট বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল ১৮.১ শতাংশ। পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময় যা ছিল ১৬.০ শতাংশ। অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত এডিপি বাস্তবায়নের হার ছিল ৬.১ শতাংশ, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের একই সময় এটি ছিল ৮.৯ শতাংশ। জুলাই-আগস্টের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, এডিপি প্রকল্পের পুনঃপ্রাধান্য নির্ধারণ এবং পুনর্মূল্যায়ন, প্রশাসনিক রদবদল এর বড় কারণ। তবে এডিপি বহির্ভূত বাজেট বাস্তবায়নের হারে জুলাই-অক্টোবর ২০২৫ অর্থবছরে কিছুটা ঊর্ধ্বগতি দেখা যায়। সিপিডি বলছে, ২০২৪ অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা এডিপি বহির্ভূত খাতসমূহে অতিরিক্ত ব্যয় হয়। আর অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ অভ্যন্তরীণ সুদের ব্যয়জনিত কারণে হয়েছে। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রায় ১০ শতাংশ প্রণোদনা প্রদানের জন্য ব্যবহূত হয়েছে। 

এর সঙ্গে প্রস্তাবিত মহার্ঘ ভাতা বাস্তবায়িত হলে এডিপি বহির্ভূত খাতসমূহে ব্যয়ের চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করে সিপিডি।