বৈশ্বিক সংকট মূল্যস্ফীতি দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ চট্টগ্রাম বন্দরের রুগ্ণ গতি থেকে মাইলফলকে পৌঁছে দিয়েছেন চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান। যদিও তিনি ২৪ সালের প্রায় ৫ মাস ২৫ সালের জানুয়ারি ১ মাস মোট ৬ মাসের মতো সময়ে পুরো ২৪ সালের গ্লানি মুছে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
২৩ সালের তুলনা নেই ২৪ সালের কন্টেইনার হ্যান্ডলিং এ ৭.৪২% ও কার্গো হ্যান্ডলিং এ ৩.১১% প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় বন্দরে কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং বেড়েছে।গত ১ বছরে ৩.২৫ মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার, ১২০ মিলিয়ন মেট্রিক টন কার্গো ও ৩ হাজার ৮৫৭টি জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে। এতে বেড়েছে আমদানি রপ্তানি। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ মনে করেন, এখন সাড়ে ৯ মিটার গভীরতার জাহাজের স্থলে ২শ মিটার দীর্ঘ ১০ মিটার গভীরতা জাহাজ ভিড়তে পারে। ফলে ১ হাজার কনটেইনার স্থলে দেড় দুই হাজার কনটেইনার নিয়ে জাহাজ ভিড়ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম পূর্বের ৪ দিনের স্থলে বর্তমানে ১ দিনে নেমে এসেছে। ফার্স্ব ট্র্যাক প্রকল্প হিসাবে জাইকার সহযোগিতায় মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পটির ২য় সংশোধিত ডিপিপি গত ২০১৪ সালের ৭ অক্টোবর তারিখে একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। কার্গো হ্যান্ডলিং যন্ত্রপাতি ক্রয় চুক্তি ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে। সিভিল কার্যক্রমের চুক্তি অতি শিগগিরই সম্পাদিত হবে এবং নির্মাণ কার্যক্রম অতিদ্রুত শুরু করা হবে। দৃশ্যমান হতে চলছে বে-টার্মিনাল প্রকল্প। এতে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে এবং বৃদ্ধি পাবে রপ্তানি এবং আধুনিক, সাশ্রয়ী টার্মিনাল সুবিধা দিয়ে কার্যক্রমের গতি ও দক্ষতা বৃদ্ধি করবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে নিলামের জন্য প্রায় ১০ হাজার কনটেইনার স্থিত। গাড়ি রাখার শেডে নিলামের জন্য দীর্ঘদিনের পুরনো ২৯৭টি গাড়ি পড়েছিল। কার শেডে নিলামযোগ্য গাড়ি দ্রুত সরিয়ে ফেলারজন্য কাস্টম কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। যাতে চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতির সূচকে আরও এগিয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রাম বন্দরে শেষের প্রাই দুই মাসে ধ্বংসযোগ্য ১৫২ টিইইউস কনটেইনারের মধ্য হতে ৫৯ টিইইউস কনটেইনারের পণ্য ধ্বংস করা হয়। নিলামযোগ্য কনটেইনার কাস্টম কর্তৃপক্ষের কাছে ১০১৭৬ টিইইউস কনটেইনার মধ্যে কাস্টম কর্তৃক ইনভেনটরিকৃত ১২৭২ টিইইউস কনটেইনার মধ্যে ৩৭ টিইইউস কনটেইনার নিলাম প্রাপকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
২৩ তুলনায় ২৪ সালে রাজস্ব বেড়েছে ২১.৩৯ %
রাজস্ব আয় ৫০৫৫.৯৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের রাজস্ব আয় ৪১৬৫.১৮ কোটি টাকা। ২৪ সালে রাজস্ব উদ্বৃত্ত ২৯৪৮.৯৭ কোটি যা গত বছরের (২১৪৩.১০ কোটি টাকা) চেয়ে ৩৭.৬০% বেশি। এফসিএল কনটেইনার অফ ডকে প্রেরণের মাধ্যমে সরকার ২ হাজার কোটি টাকা বেশি আয় করতে পারবেন এবং প্রায় ১ মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে চট্টগ্রাম বন্দরে ইয়ার্ড এবং টার্মিনালের জন্য ৪৯টি ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করেছে। বন্দরে এসে পৌঁছেছে ১২টি ইক্যুইপমেন্ট, এলসি খোলা হয়েছে ১৯টি ইক্যুইপমেন্টের এবং ১টি ইক্যুইপমেন্টের এলসি খোলার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। এছাড়া বন্দরে ভারী কার্গোহ্যান্ডেলিংয়ের জন্য লালদিয়া (উত্তর) এলাকায় একটি হেভি লিফট কার্গো জেটি নির্মাণ প্রকল্প বর্তমানে চলমান রয়েছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং কর্ণফুলী নদীর সদরঘাট হতে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত বর্জ্য অপসারণ এবং ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতাবৃদ্ধি শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে ৪৭ লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে সংরক্ষণ ড্রেজিংকার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং প্রায় ৮.৫ লাভ ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি এ বছরের জুনে শেষ হবে।
দেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি খ্যাত এই বন্দরের মাধ্যমে বাংলাদেশের মোট আমদানির প্রায় ৯২% সাধারণ পণ্য এবং প্রায় ৯৮% কনটেইনার পরিবাহিত হয়। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের এযাবৎকালের প্রায় চেয়ারম্যান সমালোচিত। সবাই টাকার পাহাড় গড়তে ব্যস্ত ছিলেন। ভাবেননি চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির হূদপিণ্ড। বন্দরের স্বাস্থ্য সুস্থ ও সবল থাকলে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য সুস্থ ও সবল থাকে। কিন্তু আগের প্রায় চেয়ারম্যান নিজের স্বাস্থ্য সুস্থ ও সবল রাখার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত ছিলেন। আ.লীগ সরকারের সময় বন্দরের দায়িত্ব থাকা চেয়ারম্যানদের ছিল না কোনো জবাবদিহি। যেন মিলেমিশে চলো ভাগ করি খাই নীতি মনে হতো। চেয়ারম্যান হিসেবে রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মুনিরুজ্জামান দায়িত্ব নিয়েছেন প্রায় ৬ মাস। এর মধ্যে নানা প্রতিকূলতা। তিনি সব বাধা-বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে শতভাগ সফল হয়েছেন।
তিনি দায়িত্ব নেয়ার আগে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পুরো বছরের অগ্রগতি মাত্র ৫ মাসে অর্জন করেছেন। তার এই অর্জনের জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। চট্টগ্রাম বন্দরের সুনাম ধরে রাখা প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করা ছিল তার জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ। একইসাথে অনিয়ম দুর্নীতি রোধ করে ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ীর আস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মুনিরুজ্জামান। বন্দরের সব মানুষের মুখে মুখে একটি কথা এত প্রতিকূলতার ভিতর কীভাবে এত অর্জন করলেন তিনি। চট্টগ্রামে বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম আমার সংবাদকে বলেন, সবার সার্বিক সহযোগিতা ও আন্তরিকতাই এগিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, কার্গো পণ্য হ্যান্ডলিংয়েও চট্টগ্রাম বন্দর এগিয়ে রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান জানান, করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতা এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেশের অর্থনীতিতেও ফেলেছে। এসব প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে গত চার মাসে বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করেছি।
প্রধান উপদেষ্টার দিকনির্দেশনায়, নৌপরিবহন উপদেষ্টার নেতৃত্বে এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সমন্বয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ দেশের সমুদ্রপথে বহির্বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। চট্টগ্রাম বন্দরকে জবাবদিহি, কল্যাণমূলক এবং অধিকতর ব্যবহারবান্ধব করার লক্ষ্যে সব কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে যেসব ক্ষেত্রে সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি অংশীদারত্বের বিষয়টি দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ও চ্যালেঞ্জ। কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল অপারেশন ও ব্যবস্থাপনায় সৌদি আরবভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল টার্মিনাল অপারেটর আরএসজিটিআইকে সম্পৃক্ত করেছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় টার্মিনাল অপারেটর এপিএমের সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণের কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।