নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব
বৈষম্যমূলক প্রস্তাব গণশুনানি স্থগিতের চিঠি ক্যাবের
বিইআরসির উচিত ছিল বৈষম্যমূলক এ প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া— অধ্যাপক বদরুল ইমাম, ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
গ্রাহকের অধিকার রক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হবে— মো. জালাল আহমেদ, চেয়ারম্যান, বিইআরসি
শিল্প খাতে গ্যাসের নতুন সংযোগে অতিরিক্তি মূল্য নির্ধারণ করছে পেট্রোবাংলা। এতে নতুন শিল্পোদ্যোক্তারা শুরুতেই হোঁচট খাবেন। উৎপাদনে আরও এক ধাপ খরচ বাড়বে। তবে পুরাতন গ্রাহকদের আগের নিয়মেই গ্যাসের দাম দিবেন। অর্থাৎ গ্যাসের নতুন সংযোগ নিতে নতুন দাম দিতে হবে গ্রাহকদের। যা আগের গ্রাহকদের তুলনায় বেশি। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে এমনটিই উল্লেখ করেছে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলার এমন বৈষম্যমূলক প্রস্তাব আমলে নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
এ ধরনের প্রস্তাব শিল্প খাতের গ্রাহকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করবে বলে মন্তব্য করেছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, এতে শিল্পে বিনিয়োগ কমবে ও অস্থিরতা তৈরি হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার নষ্ট হবে। এই বৈষম্যমূলক প্রস্তাবের বিপরীতে গণশুনানি স্থগিত করতে সম্প্রতি বিইআরসিকে চিঠি দিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। যদিও বিইআরসি থেকে বলা হচ্ছে, গণশুনানিতে প্রস্তাবটি খারিজ করার সুযোগ রয়েছে।
জানা যায়, বিইআরসি থেকে বাড়তি এ দামের অনুমোদন দিলেই বাড়বে গ্যাসের দাম। চলতি মাসেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে নিশ্চিত করেছে একটি সূত্র। বিইআরসি সূত্র জানায়, পুরোনো গ্রাহকের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের বাড়তি ব্যবহূত গ্যাসের বিল হবে নতুন দামে। যেসব শিল্পকারখানা নতুন সংযোগের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত আগের দাম দিতে হবে। এর বাইরে বাকি খরচের জন্য নতুন দাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
শিল্প খাতে গ্যাস ব্যবহারের এক চিত্র তুলে ধরেছে পেট্রোবাংলা। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে গত অক্টোবর পর্যন্ত হিসাবে দেখা গেছে, শিল্পে অনুমোদিত লোডের চেয়ে ১৪ কোটি ৭৮ লাখ ঘনমিটার গ্যাস বাড়তি ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও ক্যাপটিভে পাঁচ কোটি ৭৬ লাখ ঘনমিটার গ্যাস বাড়তি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রস্তাব অনুসারে, পুরোনো কারখানায় বাড়তি এমন ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যাসের বিল হবে নতুন দামে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম গড়ে ৮২ শতাংশ বাড়ানো হয়। তখন শিল্পে গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা। ক্যাপটিভে ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০ টাকা করা হয়েছিল। পরে ক্যাপটিভে আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা।
গত বছরের ২৮ আগস্ট গণশুনানি ছাড়াই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিইআরসির নির্বাহী ক্ষমতা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। সম্প্রতি বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ এক অনুষ্ঠানে বলেন, পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানিগুলো যেহেতু প্রস্তাব দিয়েছে, তাই আমরা আমলে নিয়েছি। গণশুনানিতে সব পক্ষের যুক্তি তর্ক শুনতে পারব। তখন সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে।
শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়াতে পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫২ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। নতুন ও বিদ্যমান শিল্পেও ঘনমিটার প্রতি ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার আবেদন করেছে পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানিগুলো। এর বিপরীতে নতুন শিল্পে ঘনমিটার প্রতি ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ৪২ টাকা করা হতে পারে। বর্তমানে দাম রয়েছে যথাক্রমে ৩০ ও ৩১ টাকা ৭৫ পয়সা।
প্রস্তাবে বলা হয়, ঘনমিটার প্রতি এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। ভ্যাট-ট্যাক্সসহ দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে গ্যাসের প্রাইস গ্যাপ কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১০১ কার্গো এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর ১১৫ কার্গো আমদানি করলে ঘাটতি ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, (নভেম্বর ২০২৩ হতে অক্টোবর ২০২৪) এক বছরে ২০৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেছেন গ্রাহকরা। পেট্রোবাংলার প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে ৪৫ টাকা হারে বাড়তি আয় দাঁড়াবে ৯২২ কোটি টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, আমদানি করা এলএনজি আগের দামে বিক্রি করলে লোকসান হয়। আবার গ্রাহকের কাছ থেকে এলএনজির দাম নিতে যে প্রস্তাব করেছে, তাতে করে শিল্প গ্রাহকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়। বিইআরসির উচিত ছিল, এ প্রস্তাব খারিজ করে দেয়া।
শিল্প খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৭০ টাকা করলে একটার পর একটা কারখানা বন্ধ হবে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. জালাল আহমেদ বলেছেন, মূল্য বৃদ্ধির যে প্রস্তাবনাই দেয়া হোক গ্রাহকের কথা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সরকারের আর্থিক অবস্থা ও গ্রাহকের অধিকার রক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হবে।