২৭তম বিসিএস

বঞ্চিত সহস্রাধিক ফিরছেন চাকরিতে

আলমগীর হুসাইন প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২৫, ১২:০৯ এএম
  • দীর্ঘ ১৭ বছর আইনি লড়াই

সুদীর্ঘ ১৭ বছর আইনি লড়াইয়ের পর অবশেষে ন্যায় বিচার পেয়েছেন ২৭তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়েও নিয়োগবঞ্চিত ১ হাজার ১৩৭ কর্মকর্তা। এই বিশাল সংখ্যক মেধাবী কর্মকর্তা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ২৭তম বিসিএসের প্রথম মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কূটকৌশলের অংশ হিসেবে উত্তীর্ণ এই চাকরি প্রার্থীদের দ্বিতীয়বার মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে ১ হাজার ১৩৭ জনকে অকৃতকার্য দেখানো হয়। যা বিধি সম্মত ছিল না। পদ বঞ্চিত এসব চাকরি প্রার্থী আইনি লড়াইয়ে নামেন এবং জয়ী হয়। 

প্রথম মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নিয়োগবঞ্চিত প্রার্থীদের তিন মাসের মধ্যে নিয়োগ দিতে নির্দেশ দিয়ে ১৬ বছর আগে হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছিলেন, তা গতকাল পুনর্বহাল করেছেন আপিল বিভাগ। এই বিসিএসে নিয়োগবঞ্চিত ১ হাজার ১৩৭ জনের পক্ষে করা পৃথক আপিল সর্বসম্মতিতে মঞ্জুর করে এ রায় দিয়েছেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ গতকাল বৃহস্পতিবার এ রায় দেন।

২৭তম বিসিএসের প্রথম মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর দ্বিতীয় মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ানিয়োগবঞ্চিত ১ হাজার ১৩৭ জনের পক্ষে তিনটি আপিল করা হয়। এই আপিলের ওপর গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বুধবার শুনানি শেষে আপিল বিভাগ গতকাল রায়ের দিন ধার্য করেন। গতকাল সকাল ১০টার দিকে রায়ের সিদ্ধান্ত অংশ ঘোষণা করেন আদালত। 

ওই বিসিএসে প্রথমবারের মৌখিক পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত বৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের অপর এক বেঞ্চের দেওয়া রায় বহাল রেখে ২০১০ সালের ১১ জুলাই আপিল বিভাগ রায় দিয়েছিলেন। এই রায় গতকাল বাতিল ঘোষণা করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। আদালতে আপিলকারীদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন ও মো. রুহুল কুদ্দুস এবং আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া। রায় ঘোষণার সময় নিয়োগবঞ্চিত প্রায় শতাধিক প্রার্থী আদালতকক্ষে উপস্থিত ছিলেন।

রায়ের পর আপিলকারী প্রার্থীদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সালাহ উদ্দিন দোলন বলেন, এ রায়ের ফলে প্রায় ১ হাজার ২০০ জনের মধ্যে যারা যোগদান করতে চাইবেন, তারা ২৭তম ব্যাচে ধারণাগত জ্যেষ্ঠতাসহ নিয়োগ পাবেন। 

দ্বিতীয় মৌখিক পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে হাইকোর্টে মামলা হয়। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার প্রথম মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল বাতিলের সিদ্ধান্ত বৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চ ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় মৌখিক পরীক্ষা অবৈধ ঘোষণা করেন। এ ক্ষেত্রে ২০৫ জন হাইকোর্টে রিট করেছিলেন।

২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর হাইকোর্টের দেয়া রায়ে দ্বিতীয় মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে যোগদান করা ব্যক্তিরা চাকরিতে থাকবেন এবং রিট আবেদনকারীদের জ্যেষ্ঠতা আইন অনুসারে নির্ধারিত হবে বলে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি রিট আবেদনকারীদের তিন মাসের মধ্যে নিয়োগ দিতে সরকারকে নির্দেশ দেয়া হয়। আপিল বিভাগের গতকালকের রায়ে হাইকোর্টের ২০০৯ সালের ১১ নভেম্বর দেওয়া রায় পুনর্বহাল করা হয়েছে।

এর আগে ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার প্রথম মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল বাতিলের সিদ্ধান্ত বৈধ ঘোষণা করে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই হাইকোর্টের অপর একটি বেঞ্চের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে নিয়োগবঞ্চিত ২৫ জন আপিল বিভাগে দুটি লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন। এদিকে হাইকোর্টের দ্বিতীয় রায়ের বিরুদ্ধে সরকার তিনটি লিভ টু আপিল করে। কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়ে আপিল বিভাগ সরকারের লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে ২০১০ সালের ১১ জুলাই রায় দেন। এই রায়ে দ্বিতীয় মৌখিক পরীক্ষা নেয়া সঠিক বলা হয়।

আপিল বিভাগের এই রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে ১ হাজার ১৩৭ জনের পক্ষে ১৪০ জন গত বছর পৃথক আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে গত বছরের ৭ নভেম্বর আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় পৃথক তিনটি আপিলের ওপর শুনানি হয়। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ২০ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার আপিল মঞ্জুর করে রায় দেন। গতকালের রায়ে ২০১০ সালের ১১ জুলাই আপিল বিভাগের দেয়া রায় বাতিল করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালের ২১ জানুয়ারি ২৭তম বিসিএসের প্রথম মৌখিক পরীক্ষায় ৩ হাজার ৫৬৭ জন উত্তীর্ণ হন। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ওই বছরের ৩০ মে প্রথম মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পিএসসি ওই বছরের ১ জুলাই প্রথম মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল বাতিল করে। ওই বছরের ২৯ জুলাই দ্বিতীয় মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় মৌখিক পরীক্ষায় ৩ হাজার ২২৯ জন উত্তীর্ণ হন। পরে তাদের চাকরিতে নিয়োগ দেয়া হয়। 

২৭তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে উত্তীর্ণ মো. ওয়াজকুরুনী দৈনিক আমার সংবাদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, আমাদের এই আইনি লড়াই দীর্ঘ ১৭ বছরে ধরে, ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে আমাদের প্রথম ফলাফল প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে আমাদের এই সুপারিশকে তারা (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) কোনো তদন্ত ছাড়াই একটা মিটিংয়ে বসে মিটিংয়ে বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেটা ছিল তাদের এখতিয়ারবহির্ভূত। কারণ, পিএসসি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, কোনো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সুপারিশকে বাতিল করার ক্ষমতা কোনো সরকারের নেই। সরকারি নির্দেশনার আলোকেই ওই সময় পিএসসি মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায়র পরও তা বাতিল করে দ্বিতীয়বার আবার ভাইবা (মৌখিক পরীক্ষা) নেয়। আমরা দ্বিতীয়বারের ভাইবা দিয়ে অনেকেই অনুত্তীর্ণ হই। এরপরে আমরা আদালতে মামলা করি। এই মামলায় আমরা রায় পাই, হাইকোর্ট থেকে আমাদের নিয়োগ দেয়ার জন্য ৩ মাসের মধ্যে নির্দেশ দেয়া হয়। এরপর এ মামলায় সরকার আপিল করে, আপিলে আমরা হেরে যাই। তারপর দীর্ঘদিন আমরা অপেক্ষা করেছি, আমার বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার পর রিভিউ পিটিশন দায়ের করি। এই রিভিউ পিটিশন এক্সেপ্ট হয়ে নিয়মিত আপিল হিসেবে গৃহীত হয়। এই সিভিল আপিল শুনানি শেষে ২০ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের ফুল বেঞ্চ আমাদের সেই হাইকোর্টের রায়কে বৈধ ঘোষণা করেন। 

আমরা মনে করি গতকালকের এ ঐতিহাসিক রায়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছে। আইনের পথে থাকলে, সত্যের পথে থাকলে, ন্যায়ের পথে থাকলে একসময় মানুষ জয়লাভ করবেই। সত্যর জয় চিরন্তন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে এটিই প্রমাণিত হয়েছে। 

মো. ওয়াজকুরুনী বলেন, আমরা আনন্দিত। সেই সঙ্গে এটাই স্মরণ করছি, দীর্ঘ ১৭ বছরে অনেকে কষ্টে ছিলেন, কর্মসংস্থান না থাকায় অনেকেই মানবেতর জীবনযাপনও করেছে, গ্লানিময় জীবনযাপন করেছে। জীবন থেকে যৌনকালটা চলে গেছে, চাকরিহীন অবস্থায়। আমাদের লড়াইয়ে যারা সহযোগিতা করেছেন, আমাদের আইনজীবী এবং অন্যান্য যারা আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আদালত যে ন্যায়বিচারের পক্ষে আমাদের রায়ের মধ্য দিয়ে সেটি আরেকটিবার প্রমাণিত হলো। অর্থাৎ বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন বাংলাদেশে আছে। আমরা আমাদের অধিকার ফিরে পেয়েছি, মহান আল্লাহর কাছে আমরা অনেক শুকরিয়া জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই।

মো. ওয়াজকুরুনী আরও বলেন, আপনাদের সকালের  কাছে দোয়া চাই, বঞ্চনার মধ্য দিয়ে আমরা মানুষের দুঃখ-কষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমরা যাতে আমাদের চাকরি জীবনে মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে ভূমিকা রাখতে পারি এই দোয়া সবার কাছে চাই এবং এটা আমাদের ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের কাছে আমাদের নিজেদের প্রতিশ্রুতি। আমরা এই সমাজ বিনির্মাণে, রাষ্ট্র বিনির্মাণে যে যেখানে আছি এই ২৭ বিসিএসের বাদ পড়া মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্য দিয়ে আমাদের চাকরি হচ্ছে, আমরা ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় আমরা আমাদের প্রাণপন চেষ্টা চালিয়ে যাব ইনশাআল্লাহ।  

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবু জাফর মানিক বলেন, দীর্ঘ ১৭ বছরের আইনি লড়াই শেষে ২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় তথাকথিত দ্বিতীয় ভাইবার (মৌখিক পরীক্ষা) নামে তৎকালীন সরকার বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ দিয়ে ১১৩৭ জন বিসিএস অফিসারকে রিকমেন্ডেশন করার পরেও সরকার এটা তাদের নির্বাহী আদেশে পিএসসির ওপর চাপিয়ে দিয়ে উত্তীর্ণদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করে। এ বিষয়ে তৎকালীন সময়ে ভুক্তভোগীরা মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করে। রিট পিটিশন দায়ের করলে মহামান্য হাইকোর্ট পিএসসিকে সরকারকে চাকরি বরখাস্তের আদেশকে তাদের চাকরি বহাল করার জন্য আদেশ দেন। কিন্তু তৎকালীন সরকারের নির্দেশে পরিচালিত আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় রহিত এবং আবার তাদের চাকরিতে পুনর্বহালে বাধসাদে। এরপর দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয় শেষে বর্তমানে আদালত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করে। গতকাল উচ্চ আদালতের আপিল বিভাগের ৫ জন বিচারপতিসহ প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ আপিল দায়ের করার পর দীর্ঘ শুনানি শেষে একমত পোষণ করে যে, পূর্বের হাইকোর্টের আদেশ বহাল থাকল এবং সিনিয়ারিটিসহ চাকরিতে পুনর্বহাল করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। এই রায়ে আলহামদুলিল্লাহ আমরা সন্তুষ্ট। আদালতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট।