প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২৫, ১২:২৭ এএম

বাজারে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য নানারকম পদক্ষেপ নেয়া হলেও কার্যত টেনে ধরা যাচ্ছে না মূল্যস্ফীতির লাগাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি কঠোর করার পাশাপাশি আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু তাতে প্রত্যাশিত সুফল মিলছে না। সাধারণ মানুষ সীমিত আয় দিয়ে এই অস্বাভাবিক দামের সঙ্গে কুলাতে পারছে না। 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭২ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৩২ শতাংশ। যদিও আগের মাস ডিসেম্বরে ছিল ৯.২৬ শতাংশ। 

অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি খানিকটা বেড়েছে। অবশ্য অর্থ উপদেষ্টাসহ সরকারের নীতিনির্ধারকরা বারবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের আশাবাদ প্রকাশ করলেও বাস্তবে এর লাগাম টানতে ব্যর্থ হচ্ছেন। 

এই পরিস্থিতির মধ্যেও অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আশা করছেন, রমজানের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। রোজার পর মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশের ঘরে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। 

শুধু অর্থ উপদেষ্টাই নন, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে তার মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি একাধিক অনুষ্ঠানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন উদ্যোগের কথা বলেছেন। এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। 

প্রসঙ্গত, আগামী জুনের মধ্যে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় অন্তর্বর্তী সরকার। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বাজেট-বিষয়ক বিশেষ বৈঠকে সরকারের পক্ষ থেকে এ পরিকল্পনা নেয়া হয়। 

এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার অপরিবর্তিত ১০ শতাংশ রেখে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। চলতি বছরের জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে নামবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। 

তিনি বলেন, ২০২৬ সালের জুনে মূল্যস্ফীতি নামবে ৫ ভাগে। আরেকটি অনুষ্ঠানে গভর্নর জানান, দেশে আগামী জুন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমার ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হবে। 

তিনি উল্লেখ করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপগুলো কার্যকর হচ্ছে না বলে সমালোচনা শুনেছি। বাস্তবে কার্যকর হচ্ছে। উন্নত দেশগুলোতেও এসব পদক্ষেপ নেয়ার পর সুফল পেতে ১০ থেকে ১২ মাস সময় লাগে। আশা করছি আগামী জুনের মধ্যে বড় অগ্রগতি হবে। 

এদিকে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ এখন আমাদের অগ্রাধিকার কর্মসূচি। তাই রমজান মাসে ভোক্তাদের স্বস্তিতে রাখতে যে কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। এজন্য তিনি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আওতাধীন দপ্তরগুলোর কর্মকর্তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। 

তিনি জানিয়েছিলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের কোনো লুকোছাপা নেই এবং মূল্যস্ফীতির পূর্ণ তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। অধ্যাপক ইউনূস আরও উল্লেখ করেন, সরকার মুদ্রানীতি ও বাজেট নীতির সঠিক সমন্বয়ের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। 

তিনি আশা প্রকাশ করেছেন যে আগামী মে মাস নাগাদ এসব পদক্ষেপের সুফল পাওয়া যাবে এবং জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে। 

তবে, তিনি স্বীকার করেছেন যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ নয় এবং এটি দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই, সরকার দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাজারে চাল, ডাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমছে না, বরং দফায় দফায় বাড়ছে। পরিবহন খরচ এবং চাঁদাবাজির কারণে পণ্য বাজারে আসার আগেই দাম বেড়ে যাচ্ছে। 

ব্যবসায়ীরা দাবি করছেন, সরবরাহ কম থাকায় বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও কাঁচামালের মূল্য অস্থির থাকায় অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়ছে। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু আশাবাদ প্রকাশ করলেই হবে না, বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বাজার মনিটরিং জোরদার, সিন্ডিকেট ভাঙা এবং আমদানি ব্যয় কমানোর মতো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। না হলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা দুরূহই থেকে যাবে। 

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি কমার আশা করা যায়, তবে এটি নির্ভর করছে বেশ কিছু অর্থনৈতিক ও নীতিগত সিদ্ধান্তের ওপর। 

এদিকে, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের শেষের দিকে মূল্যস্ফীতি ধাপে ধাপে কমতে পারে, যদি নীতি সহায়ক থাকে এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি বড় কোনো ধাক্কা না খায়। তবে দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।