পুত্রবধূকেও কুপ্রস্তাব দিয়েছিল ধর্ষক
স্বামীকে জানিয়েও পাননি প্রতিকার
১৮০ দিনে বিচার শেষ করার নির্দেশ হাইকোর্টের
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলায় বোনের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার শিশুর অবস্থা সংকটাপন্ন। ভুক্তভোগী ওই শিশুটি এখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে রয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়ার মামলার সব আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে।
এই ঘটনায় দায়ীদের ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার করতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্যাম্পাসগুলোতে মাগুরার শিশু ধর্ষণসহ সব ধর্ষণ ও নির্যাতনের দ্রুত বিচার দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন শিক্ষার্থীরা।
৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের বিচার চেয়েছেন আইন উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ধর্ষণসহ সব নির্যাতনে জড়িত অপরাধীদের ধরতে তার কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন।
অন্যদিকে দেশে নৈতিক শিক্ষার অভাবের কারণে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটছে বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান।
১৮০ দিনে বিচার শেষ করার নির্দেশ হাইকোর্টের : মাগুরায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালকে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়।
গতকাল রোববার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এর আগে মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে নিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন ব্যারিস্টার মাহসিব হোসাইন। তিনি শিশুটির স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আর্জি জানান।
পরে ধর্ষণের শিকার শিশুটির সব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অপসারণের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
এ সময় হাইকোর্ট বলেন, ধর্ষণের শিকার শিশুটির ছবি যারা প্রকাশ করছেন তারা আইন ভাঙছেন। এটা অন্যায়। ছবি নির্ধারিত সময়ে না সরালে নতুন আদেশ দেওয়া হবে।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনার তিন দিন পর ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে গতকাল মাগুরা সদর থানায় মামলা করেছেন। এতে আসামি করা হয়েছে চারজনকে। তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রেপ্তাররা হলো- শিশুটির ভগ্নিপতি সজিব শেখ, সজিবের ভাই রাতুল শেখ, বাবা হিটু শেখ ও মা জাবেদা বেগম।
এজাহারে বলা হয়েছে, আট বছরের শিশুটিকে ধর্ষণ করে তার বোনের শ্বশুর হিটু শেখ।
মামলার এজাহারে শিশুটির মা উল্লেখ করেন, ওই দিন রাতে বড় মেয়ের স্বামীর সহায়তায় তার বাবা হিটু শেখ শিশুটিকে ধর্ষণ করে। বিষয়টি হিটুর স্ত্রী ও আরেক ছেলেও জানতেন। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য তারা শিশুটিকে হত্যাচেষ্টা করে। এজাহারে আরও বলা হয়, চার মাস আগে বড় মেয়ের সঙ্গে সজিবের বিয়ে হয়। এর পর থেকে বড় মেয়েকে তার শ্বশুর অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। বিষয়টি ওই পরিবারের সবাই জানলেও প্রতিবাদ কেউ করেনি।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, চার মাস আগে মাগুরা পৌর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে শিশুটির বড় বোনের বিয়ে হয়। ওই বাড়িতে বোনের স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও ভাশুর থাকতেন। বিয়ের পর থেকে বড় মেয়েকে অনৈতিক প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন তার শ্বশুর। বিষয়টি পরিবারের অন্য সদস্যরা জানতেন। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ১ মার্চ বোনের শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে যায় আট বছরের শিশুটি।
এজাহারে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বাদী উল্লেখ করেন, গত বুধবার রাত ১০টার দিকে খাবার খেয়ে বড় বোন ও তার স্বামীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমায় শিশুটি। দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে বড় বোন ঘুম থেকে জেগে দেখেন, ছোট বোন পাশে নেই, মেঝেতে পড়ে আছে। তখন শিশুটি বড় বোনকে জানায়, তার যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়া হচ্ছে। কিন্তু বড় বোন মনে করে, শিশুটি ঘুমের মধ্যে আবোল-তাবোল বকছে। এরপর সকাল ছয়টার দিকে শিশুটি আবার বোনকে যৌনাঙ্গে জ্বালাপোড়ার কথা বলে।
কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে বোনকে জানায়, রাতে দুলাভাই (বোনের স্বামী) দরজা খুলে দিলে তার বাবা (শ্বশুর) তার মুখ চেপে ধরে তার কক্ষে নিয়ে ধর্ষণ করেন। সে চিৎকার করতে গেলে তার গলা চেপে ধরা হয়। পরে তাকে আবার বোনের কক্ষের মেঝেতে ফেলে রেখে যায়। বোন বিষয়টি মোবাইল ফোনে তার মাকে জানাতে গেলে সজীব ফোন কেড়ে নিয়ে মারধর করেন। ঘটনা কাউকে জানালে হত্যার হুমকি দেন। পরে দুই বোনকে দুই কক্ষে আটকে রাখা হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শিশুটি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লে সজিবের মা মাগুরা সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে শিশুটিকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান তিনি।
মেয়েটির বড় বোন সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার ২০ দিন আগে সন্ধ্যায় বাড়িতে কেউ ছিল না। তিনি ঘরে আলো জ্বালিয়ে টয়লেটে যান। সেখান থেকে ফিরে দেখেন ঘরে আলো বন্ধ। এ সময় হঠাৎ একজন পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে। উচ্চতা ও অন্যান্য বিষয় দেখে তিনি বুঝতে পারেন, জড়িয়ে ধরা ব্যক্তি তার শ্বশুর হিটু শেখ। বিষয়টি স্বামী সজিবকে তিনি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি।
পরে বাবার বাড়ি চলে যান। আর স্বামীর বাড়ি ফিরতে চাইছিলেন না। বাবা-মা বুঝিয়ে ছোট বোনকে সঙ্গে করে পাঠিয়ে দেন শ্বশুর বাড়ি।
পরিবার জানায়, আট বছরের শিশুটিকে গত বুধবার ধর্ষণের শিকার হয়। প্রথমে তাকে মাগুরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে স্থানান্তর করা হয় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও তার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। পরে গত বৃহস্পতিবার রাতে অচেতন অবস্থায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে গত শুক্রবার রাতে শিশুটিকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। অবস্থার আরও অবনতি হলে শিশুটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হয়।
১৫ দিনে তদন্ত, ৯০ দিনে বিচার চাইলেন আইন উপদেষ্টা
৯০ দিনের মধ্যে ধর্ষণের মামলার বিচার সম্পন্ন করতে হবে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। গতকাল আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
উপদেষ্টা বলেন, ১৫ দিনের মধ্যে ধর্ষণ মামলার তদন্ত কাজ সম্পন্ন করতে হবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এটি করতে হবে। আসিফ নজরুল বলেন, আমরা বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা মাগুরায় আছিয়ার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই এবং এ ঘটনার দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।
তিনি বলেন, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে সরকার নারী নির্যাতন আইন পরিবর্তন করছে। গত কয়েকদিনে যেসব মব জাস্টিস এবং মোরাল পুলিশিংয়ের ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দোষীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং গ্রেপ্তারের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সব ঘটনা সরকারের পর্যবেক্ষণে আছে। আমরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, কোনো অপরাধী বিচারের বাইরে থাকবে না।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নারী হয়রানি ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছি। এ পর্যন্ত নারীর প্রতি যত সহিংসতা হয়েছে সেগুলোর তালিকা করে দ্রুত তদন্ত সম্পন্নপূর্বক আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দিয়েছি। গতকাল সকালে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে দেখতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় উপদেষ্টা শিশুটির চিকিৎসার খোঁজখবর নেন এবং সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। তখন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এ ঘটনায় মামলার এজাহারভুক্ত চার আসামিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। দোষীরা যেন কোনোভাবেই ছাড় না পায় সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সোচ্চার রয়েছে।
ধর্ষণের প্রতিবাদ শিক্ষাঙ্গনে ক্ষোভ-বিক্ষোভ
সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারীর প্রতি নিপীড়ন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মাগুরায় শিশুকে ধর্ষণের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
গতকাল রোববার সকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে শিক্ষক নেটওয়ার্ক, রাজু ভাস্কর্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা, বুয়েট শহীদ মিনারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আটটি বিভাগ বিক্ষোভ করেছে। কর্মসূচি থেকে শিশু ধর্ষণে দ্রুত সময়ে বিচার, বিগত সময়ের সব ধর্ষণ-নিপীড়নের বিচার শুরু করা, ধর্ষণের ঘটনায় বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠন করার দাবি এবং নারীর প্রতি গৃহ থেকে পাবলিক পরিসরে পুলিশিংয়ের বিরুদ্ধে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিস্ক্রিয়তা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগের দাবিও ওঠে।
শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিবাদ সমাবেশ
গতকাল বেলা সাড়ে ১১টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রতিবাদ সমাবেশে ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ প্লাটফর্ম থেকে ৯ দফা দাবি জানানো হয়।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, নারীর ওপর নিপীড়ন গৃহ থেকে পাবলিক পরিসরে দেখতে পাই। এই নির্যাতনগুলো চলছে। সমাজ এই নির্যাতনকে স্বাভাবিকীকরণ করে। নির্যাতনের স্ট্রাকচার এমন হয়েছে যে, নির্যাতকরা জানে, তার কোনো শাস্তি হবে না। আর নারীকে দোষ দেবে, সে কেন পথে বেরিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, একেবারে মাইক্রো লেভেল থেকে এই নির্যাতন টিকিয়ে রাখার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। যদি না এই নিপীড়নের বিরুদ্ধে না দাঁড়ান তাহলে তিনি নির্যাতক ব্যবস্থার অংশ। এটা ঠেকাতে হবে প্রত্যেককে। সবাই একসঙ্গে মিলে নারী, দুর্বলের ওপর নির্যাতন রুখে দেওয়া সম্ভব। চলমান নারীর প্রতি সহিংসতার কথা উল্লেখ করে ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক তাসনীম মাহবুব বলেন, নারী উপদেষ্টারা কী আদৌ আছেন দেশে কী ঘটছে, ওনারা কী সে ব্যাপারে সচেতন ওনারা তো এগিয়ে আসতে পারেন, সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। কিন্তু সেরকম কোনো উদ্যোগ দেখছি না।
এদিকে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীরা সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ চত্বরে, রাজু ভাস্কর্যে প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ, ইংরেজি বিভাগ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ভূতত্ব বিভাগ, বাংলা বিভাগসহ একাধিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা পৃথক ব্যানারে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করেন। তারা মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষকদের ফাঁসির দাবি জানান এবং ধর্ষণের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
রাজু ভাস্কর্যে ঢামেকের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ
ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাও রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে গতকাল বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। তারা নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদ জানিয়েছেন এবং ধর্ষকের ফাঁসি দাবি করেছেন। শিক্ষার্থীরা জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে দোষী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেখতে চান তারা। বিশেষ করে মাগুরায় ৮ বছরের শিশু ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেন তারা।
বুয়েট শিক্ষার্থীদের ছয় দফা দাবি
ধর্ষণের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। এ সময় ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুয়েট একতাবদ্ধ উল্লেখ করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডসহ ছয়টি দাবি উত্থাপন করেছেন তারা।
গতকাল সকালে মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা বলেন, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পদক্ষেপ দৃশ্যমান ও সন্তোষজনক নয়। তারা দাবি জানান- দেশের ধর্ষণ আইন পরিবর্তন করে দ্রুত ট্রাইবুনালের মাধ্যমে শাস্তি দ্রুত সময়ে কার্যকর করতে হবে; মাগুরায় শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের এই নতুন আইনে দ্রুত সময়ের মধ্যে নজিরবিহীন শাস্তি কার্যকর করতে হবে; সম্প্রতি দেশে ঘটে যাওয়া সব নারী নির্যাতনের ঘটনায় অভিযুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে; নারী নির্যাতনের ঘটনায় আইনি প্রক্রিয়া ও বিচারিক কার্যক্রম দ্রুততম সময়ে করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে; আইনি সহায়তা ও বিচারের প্রক্রিয়া নারীবান্ধব করে তুলতে হবে; সর্বোপরি বাড়িতে, বাইরে সর্বত্র নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারের পদক্ষেপ দৃশ্যমান ও কার্যকর হতে হবে।
জাবির সাংবাদিকতা বিভাগের মানববন্ধন
দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও অপরাধীদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গতকাল রোববার দুপুর দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে এ মানবন্ধন করেন তারা। এতে বিভাগটির প্রায় অর্ধশত শিক্ষক-শিক্ষার্থী অংশ নেন।
মানবন্ধনে তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সারাদেশে একের পর এক ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে চলছে। সাধারণ মানুষ বিশেষত নারী ও শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এ অবস্থায় দেশে নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা।
ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে রাবি শিক্ষার্থীদের অবরোধ
দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ এবং ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবিতে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
গতকাল রোববার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এই কর্মসূচি পালন করা হয়। এতে মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা।
বেলা ১১টার দিকে বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে প্যারিস রোডে জড়ো হতে থাকেন। বেলা সাড়ে ১১টার কিছুক্ষণ পর শিক্ষার্থীরা একটি মিছিল নিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করেন। বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে সোমবার (আজ) একইভাবে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে বেলা সাড়ে ১১টায় মহাসড়ক অবরোধ করার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে আমি কে আছিয়া আছিয়া’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, ধর্ষকদের কবর দে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, নো মোর র্যাপিস্ট’, ‘আমার বোনের কান্না, আর না আর না’, ‘একটা একটা ধর্ষক ধর, ধরে ধরে বিচার কর’, ‘খুনি কেন বাহিরে, ইন্টেরিয়ম জবাব চাই’, ‘বিচার বিচার চাই, ধর্ষকের বিচার চাই’, ‘গোলামি না আজাদী, আজাদী আজাদী’ প্রভৃতি স্লোগান ও প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘সারা দেশে ধর্ষণের ঘটনায় যদি কোনো বিচার করতে না পারেন, তাহলে শেখ হাসিনার অবস্থাটা মনে করিয়ে দিতে চাই। আমাদের যেন আবার ১ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামতে না হয়।
মহাসড়ক অবরোধ করে ইবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
মাগুরায় ৭ বছরের শিশু ধর্ষণে অভিযুক্তের জনসম্মুখে ফাঁসি ও জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থীরা। এ সময় ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও প্রদান করেন তারা।
গতকাল রোববার দুপুর সোয়া ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন খুলনা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশে করেন তারা। এর আগে, দুপুর ১২টায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হয়। পরে মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে প্রধান ফটকসংলগ্ন সড়কে অবস্থান নেয়। পরে সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
আজ সারা দেশে মানববন্ধন করবে ছাত্রদল
দেশব্যাপী নারীদের ওপর সহিংসতা, নিপীড়ন, ধর্ষণ, অনলাইনে হেনস্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি ও বিচারহীনতার প্রতিবাদে আজ সোমবার সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে ছাত্রদল। গতকাল রোববার ছাত্রদলের দপ্তর সম্পাদক (সহ-সভাপতি পদমর্যাদা) মো. জাহাঙ্গীর আলমের পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়।
বার্তায় বলা হয়েছে, দেশব্যাপী নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, নিপীড়ন, ধর্ষণ, অনলাইনে হেনস্তা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি ও বিচারহীনতার প্রতিবাদে সোমবার (আজ) বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।