অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের অভাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচারে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অস্ত্রোপচারের আগে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশটি হলো অ্যানেস্থেসিয়া। কিন্তু অ্যানেস্থেসিওলিস্টের অভাবে অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর ওপর চেতনানাশক প্রয়োগে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগীর নানা ধরনের বিপত্তি বা মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। বর্তমানে গোটা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংকটের কারণে ওই ধরনের দুর্ঘটনা বাড়ছে। আর বর্তমানে দেশে গুরুতর অস্ত্রোপচারের চাহিদা ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালগুলোয় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংকট আরও তীব্র হয়েছে। চিকিৎসা খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের চাহিদা। মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারতের ভিসা পাওয়ার জটিলতায় দেশের হাসপাতালগুলোতেই বেড়ে গেছে অস্ত্রোপচার বা জটিল চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা। তাতে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের চাপও বেড়েছে। বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও পেইন ফিজিশিয়ানসের (বিএসএসিসিপিপি) তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশে ১ হাজার ৯৫২ জন তালিকাভুক্ত বিশেষজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছে। তার বাইরেও আরও পাঁচ শতাধিক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট রয়েছে। কিন্তু দেশের স্বাভাবিক চাহিদা বিবেচনায় ওই সংখ্যা যথেষ্ট নয়।
সূত্র জানায়, দেশে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কোনো কোনো হাসপাতালে এখন অভিজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের জায়গায় দুই বছর মেয়াদি ডিপ্লোমাধারীদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের আগের গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল ওই কাজটি অদক্ষ নার্সদের দিয়ে করানো হচ্ছে। ফলে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
বর্তমানে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচারের হার তুলনামূলক বেশি বেড়েছে। রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে গত কয়েক মাসে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা কয়েক গুণ পর্যন্ত বেড়েছে। আবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিএসএমএমইউসহ বিভিন্ন সরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রেও অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে সবখানেই এখন অতিরিক্ত অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের প্রয়োজন পড়ছে। তার মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের প্রয়োজন বেশি পড়ছে।
কারণ সাধারণত যে হারে এদেশে অস্ত্রোপচার হয়, বিভিন্ন করপোরেট হাসপাতালে এখন তার প্রায় দ্বিগুণ অস্ত্রোপচার হচ্ছে। মূলত বর্তমানে চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ ভারতে যাওয়ার জটিলতায় দেশে অস্ত্রোপচারের রোগীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে ক্যান্সার রোগীরা ও ট্রান্সপ্লান্টের রোগীরা হাসপাতালে ফলোআপের জন্য বেশি ভিড় করছে।
সূত্র আরও জানায়, বর্তমানে দেশে অস্ত্রোপচারের তুলনায় অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের সংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় কম। তাছাড়া কাজের তুলনায় বেতন অনেক কম হওয়ায় নতুন নতুন বিশেষজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট যোগদান করছে না। আর বেতন বৈষম্যের কারণেও অনেক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আগ্রহ হারাচ্ছেন। মেডিকেল শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এখন অবেদন বিদ্যায় শিক্ষাগ্রহণের আগ্রহ ব্যাপক মাত্রায় কমেছে। মূলত প্রাইভেট চেম্বার করে রোগী দেখার সুযোগ না থাকা, উপযুক্ত ফি না পাওয়া, সার্জনদের ওপর নির্ভরশীলতাসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীরা এখন আর ওই বিষয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী হচ্ছে না।
এদিকে দেশের সব টারশিয়ারি হাসপাতালে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, অবকাঠামো ও ফ্যাসিলিটিজের অভাব, কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকি, জনগণের অ্যানেস্থেসিয়া সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব ইত্যাদি নানা কারণেই তরুণ চিকিৎসকরা এ পেশায় ক্যারিয়ার করতে অনুৎসাহিত হচ্ছে। অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট ও সার্জন একে অন্যের ওপর সমানভাবে নির্ভরশীল। পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশেষজ্ঞ অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট হাসপাতালগুলোয় সেবার মানকে বহুলাংশে বাড়িয়ে দিতে সক্ষম। অথচ পেরিফেরিতে অদক্ষ ও অবৈধ অজ্ঞান ডাক্তারদের আনাগোনা প্রচুর। ফলে বিপন্ন হচ্ছে সুচিকিৎসা, প্রতিনিয়ত ঝুঁকিতে পড়ছেন সংশ্লিষ্ট রোগীরা। পরিস্থিতি উত্তরণে পর্যাপ্ত পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে সুনজর জরুরি।
অন্যদিকে অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের অভিযোগ, বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় সার্জন এবং অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের মধ্যে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। ফলে তাদের অনেকেই পেশাগত বিশেষায়নে পরিবর্তন আনছেন। অথচ বাংলাদেশে অনেক বেশি অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট প্রয়োজন। কেননা বর্তমান সবকিছুতেই অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের দরকার হয়। কিন্তু দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোয় যে পরিমাণ অ্যানেস্থেসিওলজিস্টের পদ রয়েছে, সে অনুপাতে সার্জনের সংখ্যা বেশি। ফলে অধিক অপারেশনে স্বল্পসংখ্যক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট কাজ করার কারণে তাদের ওপরে কাজের চাপ বেশি পড়ে। যদিও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে প্রশিক্ষণ বা সনদ ছাড়াই অনেকে অ্যানেস্থেসিয়ার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আবার অনেকে নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়েও যুক্ত হয়েছে। ওসব কারণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কিছু দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটছে। সার্বিক দিক পর্যালোচনা করলে অ্যানেস্থেসিয়া বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পদ যেমন বাড়ানো দরকার, একই সঙ্গে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার জন্য চিকিৎসকদের আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা দেয়াও জরুরি।
এ বিষয়ে বিএসএসিসিপিপির সাধারণ সম্পাদক ডা. শামসুল আরেফিন সুমন জানান, সব হাসপাতালেই ডাক্তারের নাম বিলবোর্ডে থাকে বা স্ক্রলিংয়ে আসে। কিন্তু অ্যানেস্থেসিওলজিস্টদের নাম আসে না। রোগীরা জানতে পারছে না তাদের অ্যানেস্থেসিয়া কারা করছে। বিগত ২০০৮ সালে একজন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট যে বেতনে চাকরিতে যোগদান করেছেন, এখনো তিনি একই বেতন পান। আর প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর হিসাব হলো, ভালো লাগলে চাকরি করো, না পোষালে ছেড়ে যাও। এমন অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে দিন দিন এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। যা ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ।