বাংলাদেশ ছাড়ছেন অবৈধ বিদেশিরা

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: মার্চ ২১, ২০২৫, ১২:০২ এএম

১৮ নভেম্বর থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত ৪৩ হাজার ১৬৮ জন অবৈধ বিদেশি নাগরিক কমেছে

বিপুলসংখ্যক অবৈধ বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশ ছেড়েছে। সম্প্রতি দেশে নিয়মবহির্ভূতভাবে অবৈধভাবে থাকা বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে চালানো হয় অভিযানসহ নানামুখী তৎপরতা। তাতে গত ১৮ নভেম্বর থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত ৪৩ হাজার ১৬৮ জন অবৈধ বিদেশি নাগরিক কমেছে। আর গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে ৪০ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। তারপরও মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসাসহ অবৈধভাবে ছয় হাজার ৯৭ জন বিদেশি নাগরিক এদেশে অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে শীর্ষ পাঁচটি দেশ হলো ভারত, চীন, নেপাল, পাকিস্তান ও ফিলিপাইন। অবৈধভাবে বসবাসকারীর মধ্যে এখন ভারতীয়ের সংখ্যা ৩ হাজার ৩৯৯, চীনের ১ হাজার ৯৯, নেপালের ৩৭৬, পাকিস্তানের ১৪০ ও ফিলিপাইনের ১৩১ জন। তিন মাস আগেও দেশে ৪৯ হাজার ২৬৫ জন অবৈধ বিদেশি নাগরিক ছিল। পুলিশ বিভাগ এবং ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর (ডিআইপি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশে বর্তমানে ৮৩ হাজার ৬৮৬ জন বিদেশি নাগরিক বৈধভাবে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ১৬ হাজার ৮৬৬ জন, ভারতীয় ১৪ হাজার ২৭৭, যুক্তরাজ্যের ১০ হাজার ৫৮২, চীনের ৮ হাজার ৬৪ ও কানাডার ৬ হাজার ৯৩ জন। তবে তার বাইরেও অনেক দেশের নাগরিকরা বৈধভাবে দেশে বসবাস করছে। গত বছরের মে মাসে হাইকোর্ট দেশে অবস্থানরত বৈধ ও অবৈধ বিদেশি কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিরূপণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওসব বিদেশি কর্মী কীভাবে ও কোন চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের অর্থ দেশের বাইরে পাঠান, সে বিষয়েও অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।  তারপর গত বছরের ১৮ নভেম্বর থেকে দেশে বসবাস করা অবৈধ বিদেশি নাগরিক শনাক্ত ও তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে নানা কার্যক্রম শুরু হয়। তখন দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে এক লাখ ১১ হাজার ৫৮১ জন বিদেশি নাগরিক ছিল। এরপর অবৈধ নাগরিকদের মধ্যে কারা কোন প্রক্রিয়ায় অবস্থান করছে তা শনাক্ত করতে তদন্ত শুরু হয়। আর ওই তৎপরতা শুরুর পর ৩ হাজার ১২৫ জন দেশ ত্যাগ করেছে। ৩০ জনের মারা যাওয়ার তথ্য মিলেছে। 

ভুল ঠিকানা ব্যবহার করেছে এমন বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১ হাজার ৮৪৭ জন। আর সঠিক ঠিকানায় রয়েছে তবে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে এই সংখ্যা ৪৮১। বাংলাদেশে অবস্থানরত অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের জানুয়ারি মাসের মধ্যে বৈধতা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। অন্যথায় অবৈধভাবে অবস্থানকারী ব্যক্তি ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেয়া হয়।

সূত্র জানায়, বিদেশি নাগরিকরা বেশ কয়েক ধরনের ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারে। তার মধ্যে কর্মসংস্থান, ব্যবসা ও বিনিয়োগ ভিসা এবং পর্যটক ভিসা রয়েছে। এদেশে অবস্থানকারী  অনেক বিদেশি নাগরিকের তথ্য হালনাগাদ ছিল না। আবার অনেকে বাংলাদেশে অবস্থান করেও ভিসার মেয়াদ বাড়ায়নি। আবার কেউ কেউ নতুনভাবে ভিসা নিলেও তার ডেটা এন্ট্রি করা হয়নি। ইমিগ্রেশন সিস্টেমে নতুন পাসপোর্ট ও ভিসা গ্রহণের তথ্য ছিল না। আবার কেউ কেউ এক ধরনের ভিসায় দেশে পরে ভিসার শ্রেণি পরিবর্তন করেছে। তবে পরিবর্তিত ভিসার তথ্য আপডেট না করায় তিনি অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। আবার ৫ আগস্টের পর অনেক ভারতীয় নাগরিক স্থলবন্দর ও সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশ ত্যাগ করেন। আবার ট্যুরিস্ট ও বিজনেস ভিসায় অনেকে এসে স্টুডেন্ট ভিসা গ্রহণ করলেও ওই তথ্য ইমিগ্রেশনে আপডেপ ছিল না। এসব আপডেট করার কাজ চলছে। তাছাড়া যারা অবৈধভাবে এদেশে অবস্থান করছে তাদের মধ্যে আরেকটি শ্রেণি রয়েছে। তারা মূলত অনেক বছর ধরে ভারত, পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে। যে কোনোভাবে তারা সেসব দেশের পাসপোর্টধারী হয়। তারপর জীবনসায়াহ্নে তাদের কেউ কেউ বাংলাদেশে ফিরছে। তারা ভিন্ন দেশের পাসপোর্ট নিয়ে ফিরলেও ফের দেশ ছাড়ছে না। তাই এসব পাসপোর্টধারী অবৈধ হয়ে যাচ্ছে। 

তবে অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হলে অনেকেই জরিমানা দিয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন মাসে অবৈধ নাগরিকদের কাছ থেকে ৪০ কোটি ২৭ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়েছে। গত ডিসেম্বরে আদায় হয়েছে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৫৮ হাজার টাকা। জানুয়ারি মাসে ৩২ কোটি ৫৩ লাখ ৪৮ হাজার ৬০১ টাকা এবং ফেব্রুয়ারিতে ২ কোটি ৪৭ লাখ ৫৯ হাজার টাকা আদায় হয়েছে। তাছাড়া অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের অনেকে আয়করের আওতায় এসেছে।

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের বিরুদ্ধে ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৬৪’র অধীনে সংশ্লিষ্ট আদালতে মামলা করার অনুমোদন দিতে পারে এসবির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক। যদিও অনেকের মতে, অনেক বিদেশি নাগরিক এদেশের আইনি দুর্বল কাঠামোর সুযোগ নিচ্ছে। আবার মেয়াদোত্তীর্ণ ভিসাধারীরা নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। তারা প্রতারণা, জালিয়াতি, মাদক পাচার, মুদ্রা লেনদেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, স্বর্ণ চোরাচালান, ক্যাসিনোর মতো অপরাধে সম্পৃক্ত হচ্ছে। অনেকে আবার অবৈধ চ্যানেলে নিজ দেশে অর্থ পাচারও করে। বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে ৩৩ ুধরনের ভিসা দেয়া হয়। তবে অনেকে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও অবস্থান করছে। বিশেষ করে ‘ভিসা অন অ্যারাইভাল’ এবং ব্যবসায়িক ভিসা ব্যবহারকারীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। আগে ভিসার মেয়াদ শেষে দিনে জরিমানা করা হতো ২০০ টাকা এবং মাসিক ১০ হাজার টাকা। তিন মাস পর্যন্ত থাকার জন্য সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা। গত ডিসেম্বরে তা সংশোধন করা হয়। এখন ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রথম ১৫ দিনের জন্য জরিমানা এখন প্রতিদিন ১ হাজার টাকা। ১৫ দিন পর থেকে ৯০ দিন পর্যন্ত জরিমানা প্রতিদিন ২ হাজার টাকা। তারপর ৯১ দিন থেকে প্রতিদিনের জরিমানা ৩ হাজার টাকা।

এদিকে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, কোনো বিদেশি নাগরিককে অবৈধভাবে বাংলাদেশে থাকতে দেয়া হবে না। অনেক দেশের নাগরিক অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করার তথ্য রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি ইনামুল হক সাগর জানান, অবৈধভাবে যেসব বিদেশি বসবাস করছে, তাদের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে কার্যক্রম চলছে। এরই মধ্যে অনেক অগ্রগতি হয়েছে।