চালের বাজারে অস্বস্তি কাটছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: মার্চ ২২, ২০২৫, ১২:২৮ এএম
  • শ্রেণিভেদে দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৫-৮ টাকা

  • ধানের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা

সরকারের সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করায় বাজারে স্বস্তি ফিরেছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে - বাণিজ্য উপদেষ্টা

অন্যান্য পণ্যে নিয়মিত বাজার তদারকি করা হলেও চালের বাজারে সেরকম তদারকি বা অভিযান দেখা যায় না – ক্যাব

বিগত বছরগুলোর তুলনায় চলতি বছর রমজানে অধিকাংশ পণ্যের দাম নিম্নমুখী। ক্রেতারা স্বস্তি কিনছেন পছন্দের পণ্যসামগ্রী। কিন্তু চালের দামে থেকে গেছে অস্বস্তি। রাজধানীর বাজারে প্রায় সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। শ্রেণিভেদে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে চালের দাম।

দুই সপ্তাহে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে পাঁচ থেকে আট টাকার মতো বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মিনিকেটের দাম অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় আরেক সরু চাল নাজিরশাইলের দামও কেজিতে এক-দুই টাকা বাড়তি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে চালের অন্যতম বড় পাইকারি বাজার নওগাঁ ও কুষ্টিয়ায় দাম বেড়েছে। কুষ্টিয়ায় গত ১৫ দিনে কেজিতে মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে সাত টাকা। মিলগেটে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৮৪ টাকা। অন্যদিকে নওগাঁয় এক সপ্তাহে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে তিনুচার টাকা বেড়েছে।

চালকল মালিকরা ধানের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছেন। ব্যবসায়ীরা জানান, বোরো ধান বাজারে না আসা পর্যন্ত এ সংকট থাকবে। তবে স্থিতিশীল রয়েছে মোটা চালের দাম। ভারত থেকে কিছু চাল আসছে। তা মূলত কাটারিভোগ জাতের। দাম প্রতি কেজি ৭০-৭২ টাকা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, বাজারের অন্যান্য পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও চালের বাজারের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি সরকার। দাম বৃদ্ধির সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান তারা।

হঠাৎ করে দফায় দফায় চালের দাম বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্রেতারা। সংসারে বাড়তি খরচ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ। অসাধু চালকল মালিকদের কারসাজি ঠেকাতে বাজারের প্রতি নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন ভোক্তারা। তবে চালকলের মালিকেরা ধানের মূল্য বৃদ্ধি ও ধান সংকটকে দায়ী করছেন।

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে এখন অস্বস্তি শুধু চালের দামে। এখন রাজধানীর বাজারে ভালোমানের সরু চাল কিনতে প্রতি কেজিতে দাম দিতে হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। মাঝারি চালের দাম ৭০ থেকে ৭৬ টাকা আর মোটা চাল কিনতে ৫৮ থেকে ৬২ টাকা দিতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে।

চালের খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত ছয় মাসে তিন দফা চালের দাম বেড়েছে। সবকিছু হিসাবে নিলে কেজিপ্রতি প্রায় ৮ থেকে ১০ টাকা দাম বেড়েছে। এর মধ্যে শুধু একদফা দুই-এক টাকা কমেছিল। শনিরআখড়ার শরিফ জেনারেল স্টোরের মালিক আমার সংবাদকে বলেন, শেষ গত এক সপ্তাহে আবারও চালের দাম বেড়েছে। রশিদ, উৎসব, ডায়মন্ড, মোজাম্মেল ইত্যাদি জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের সরু মিনিকেট চালের ২৫ কেজির বস্তায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা বেড়েছে।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিনিকেট চালের মজুত শেষের দিকে। বোরো মৌসুমে এ চালের উৎপাদন হবে। এখন বোরো ধান কৃষকের ক্ষেতে রয়েছে। বোরোতে ভালো ফলন হলে দাম কমতে পারে।

মাঝারি ও মোটা চালের দাম বাড়েনি। অবশ্য সব ধরনের চালের দাম আগে থেকেই চড়া। সরকার নিজে আমদানি করছে, বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করছে, কিন্তু চালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমছে না।

তিনি বলেন, আসলে ৮০ টাকার নিচে কোনো ভালো মানের চাল পাওয়া যায় না। আর বড় বড় ব্র্যান্ডের মিনিকেটের দাম আরও বেশি, ৯০ থেকে ৯২ টাকার আশপাশে। ফলে মধ্যম আয়ের মানুষকে ৮০ টাকা কেজি চাল কিনতে হচ্ছে।

মোটা চালের দামও কম নয়। রামপুরাসহ হাজীপাড়া মালিবাগ মৌচাকবাজার ঘুরে অবশ্য ৫৮ টাকার নিচে কোনো মোটা সেদ্ধ চাল পাওয়া যায়নি। মোটামুটি ভালোমানের মোটা চাল কিনতে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা দিতে হচ্ছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। একসঙ্গে বেশি পরিমাণে নিলে দু-এক টাকা কম পাওয়া যায়।

যাত্রাবাড়ীতে চাল কিনতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী রমজান আলী বলেন, এ বছর রোজায় সবজিসহ অন্যান্য পণ্য অনেক কম দামে পাচ্ছি। কিন্তু চালের দাম চড়া। দাম দফায় দফায় বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের মতো কম আয়ের মানুষের পক্ষে এখন কঠিন হয়ে পড়েছে।

সজিব নামের অপর ক্রেতা বলেন, সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে মিনিকেটের চাল খেতাম। আজ ২৮ চাল ক্রয় করলাম।

কুষ্টিয়া মিনিগেট চাল উৎপাদন বন্ধ

এদিকে কুষ্টিয়া বন্ধ হয়ে গেছে মিনিকেট চাল উৎপাদন। তাই দাম চড়া। সরু চালের জন্য সর্ববৃহৎ ও প্রসিদ্ধ মোকাম কুষ্টিয়ার খাজানগর। এখানকার উৎপাদিত চাল যায় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়। সেই মোকামের ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের গোডাউনে ধান নেই। এ কারণে বন্ধ হয়ে গেছে চাল উৎপাদন। এ সুযোগে খুচরা বাজারে বেড়েই চলেছে মধ্যবিত্তের সবচেয়ে পছন্দের মিনিকেট চালের দাম।

খাজানগরেরও কয়েকটি অটোরাইস মিল ও অটোরাইস মিল মিনিকেট চাল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের দাবি, বাজারে মিনিকেট ধান পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য তারা চাল উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। তবে এসব কোম্পানির নামে চাল ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে খুচরা বাজারে। কিন্তু দামটা আকাশছোঁয়া। মিলগেটে প্রতিকেজি মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮১ টাকা কেজি দরে। খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে আরও বেশি দামে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে ধান না থাকলেও অনেক মিলারের কাছে প্রচুর ধান রয়েছে। সুযোগ বুঝে চাল উৎপাদন করে ঠিকই বাড়তি মুনাফা অর্জন করছেন। কিন্তু প্রশাসনকে দেখাচ্ছেন ধান নেই।

চালের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে বলে মনে করে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন। সংস্থাটির সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন আমার সংবাদকে বলেন, সরকার আসলেই চালের সিন্ডিকেট ভাঙতে চায় কিনা সেটা আগে জানতে হবে। অন্য পণ্যে কিন্তু নিয়মিত বাজার তদারকি করা হয়। চালের বাজারে কিন্তু সেরকম তদারকি বা অভিযান দেখা যায় না। চালের বাজার পুরোটাই ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে। তারা তাদের মতো করে দাম নির্ধারণ করছেন। ব্যবসায়ীরা বলছে কর্পোরেট দাম বাড়ায় আর কর্পোরেট বলছে ব্যবসায়ী দাম বাড়ায়। দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে ভোক্তারা পিষ্ট হচ্ছে। তবে সরকারের সদিচ্ছা থাকলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

এদিকে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। সমপ্রতি তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেন, সরকারের সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করায় বাজারে স্বস্তি ফিরেছে, অনেক পণ্যের দাম কমেছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার কাজ করছে।

বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বাজারে কিছু কিছু পণ্যে স্বস্তি এসেছে, কিছু পণ্যে আসেনি। চালের বাজার নিয়ে কাজ চলমান। সরবরাহ ব্যবস্থা চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী। চালের বাজার সহজীকরণের (দাম কমানোর) চেষ্টা করা হবে।