লাগামহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: এপ্রিল ১৬, ২০২৫, ১২:০১ এএম

বর্তমানে দেশের ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য নেই, ৮৬টিতে নেই  উপ-উপাচার্য তাছাড়া কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) নেই ৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে

দেশে কর্মরত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে লাগামহীনভাবে। সরকার কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। বর্তমানে দেশের ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্য নেই। আর ৮৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপ-উপাচার্য নেই। তাছাড়া কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) নেই ৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়নি।

অভিযোগ রয়েছে অনিয়ম করতেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ এসব পদ কৌশলে দীর্ঘদিন ধরে ফাঁকা রাখা হচ্ছে। আর সরকার চেষ্টা করেও লাগামহীন এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে কর্মরত বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নির্দেশনা তোয়াক্কা না করা, বিধিবহির্ভূতভাবে একাডেমিক প্রোগ্রাম পরিচালনা, দীর্ঘ সময়েও স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া, যেনতেনভাবে পাঠদান শেষে সার্টিফিকেট প্রদান ছাড়া আরও অনেক অনিয়মে জড়িত রয়েছে। আর অনিয়ম করতেই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদগুলো বছরের পর বছর ফাঁকা রাখছে। মূলত খেয়ালখুশিমতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেই এ অনিয়ম করা হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী ও একাডেমিক কর্মকর্তা হলেন উপাচার্য (ভিসি)। তিনি সিন্ডিকেট ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সিদ্ধান্ত বান্তবায়ন করবেন। কিন্তু না থাকায় ওসব প্রতিষ্ঠান খেয়ালখুশি মতো চলছে।

সূত্র জানায়, যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই তার মধ্যে রয়েছে পিপলস ইউনিভার্সিটি, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে শূন্য), ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে), প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি (২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে), প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় (২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে), নর্দান ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া (২০২১ সালের জুন থেকে), ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি (২০২২ সালের জুলাই থেকে), প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা (২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে), ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস, রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (২০২২ সালের জুলাই থেকে), কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি (২০২১ সালের এপ্রিল থেকে), গ্লোবাল ইউনিভার্সিটি, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, আর্মি ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সৈয়দপুর (২০২২ সালের নভেম্বর থেকে), আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি নাটোর (২০২৩ সালের মে থেকে), আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কুমিলা, নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ডটেকনোলজি (২০২০ সালের অক্টোবর থেকে), সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিসহ (২০২৩ সালের জুন থেকে) আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও আয়-ব্যয়ের হিসাব সংরক্ষণ ট্রেজারার করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট প্রণয়ন, আর্থিক শৃঙ্খলাও তার দায়িত্ব। কিন্তু অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই ট্রেজারার নেই। প্রতিষ্ঠার পর ট্রেজারার নিয়োগ করা হয়নি এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে দ্য মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, এনপিআই ইউনিভার্সিটিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

সূত্র আরও জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদগুলো ফাঁকা থাকার অনেক কারণ রয়েছে। দেশে ১১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ওই হিসেবে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও ট্রেজারারের মোট ৩৪৮টি পদ রয়েছে। আর প্রতিটি পদের জন্য যোগ্য তিন অধ্যাপকের প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হয়। ওই হিসেবে এক হাজার ৪৪ জন যোগ্য অধ্যাপক প্রয়োজন। পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় মিলে এর বেশি অধ্যাপক থাকলেও অনেক অধ্যাপকই সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চান না। যে কারণেও ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার নিয়োগের প্যানেল প্রস্তুত করতে ট্রাস্টি বোর্ডকে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের মতে, বড় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক অধ্যাপক থাকায় তারা ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার পদের জন্য ৯ জন অধ্যাপকের প্রস্তাব পাঠাতে সমস্যা হয় না। কিন্তু তুলনামূলক ছোট বা নবীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের জন্য অধ্যাপক খুঁজে পাওয়া কষ্টকর। সরকারকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি ও ট্রেজারের নিয়োগ না হওয়ার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যর্থতাও রয়েছে।

অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ জানান, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের আইন মেনে চলছে। তারা নিয়মিতভাবে ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগের প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। আর যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সরকারের আইন মেনে চলছে না, যথাযথভাবে কাজ করছে না, সেগুলোর ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়া যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যথাযথ শিক্ষার মান বজায় রয়েছে কিনা তা নিয়েও ভাবার সময় এসেছে।