বেনজীরের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারি

ইন্টারপোলের রেড নোটিশে ৬২ বাংলাদেশি

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: এপ্রিল ২৩, ২০২৫, ১২:০৭ এএম

রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজ শিক্ষার্থী সামিয়া আফনান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতার পাশাপাশি বিদেশে পলাতক হিসেবে পুলিশের তালিকাভুক্ত জিসান, ফ্রিডম মানিক, বিকাশ ও মোল্লা মাসুদ এবং মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকার নবী হোসেন ও আর্মি আলমগীরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ যাচাই করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা। এভাবে বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত অনেকে দীর্ঘদিন বিদেশে পালিয়ে থাকলেও দেশীয় সহযোগীদের সহায়তায় বিভিন্ন এলাকা থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে সহযোগীরা গ্রেপ্তার হলেই বিদেশে অবস্থানরত অপরাধজগতের এসব শীর্ষ ব্যক্তির নাম বারবার আলোচনায় আসে। বিদেশে বসে অপরাধ চালিয়ে যাওয়া এসব ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তা চেয়ে আসছে পুলিশ। সদস্য রাষ্ট্র থেকে এ ধরনের আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাওয়ার পর ইন্টারপোল এসব ব্যক্তির নামে জারি করে রেড নোটিশ।

বর্তমানে বাংলাদেশের এ ধরনের ৬২ ব্যক্তিসহ ১৯৫টি সদস্য দেশের ছয় হাজার ৫৮১ জনের নাম ঝুলছে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ বোর্ডে। অপরাধে করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের নাম ইন্টারপোলে পাঠানো ও তদারকির দায়িত্ব ঢাকার পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি)। এই শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন অপরাধ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন এমন ৬৪ ব্যক্তির নাম ও অপরাধের বিস্তারিত তথ্য ইন্টারপোলের কাছে পাঠানো হয়েছে রেড নোটিশ জারির জন্য।

এর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, হত্যা, মাদক ও মানবপাচার, অবৈধ অস্ত্র রাখা, বিস্ফোরক ও বিপজ্জনক অস্ত্র মজুত, টাকা ও স্ট্যাম্প জাল করা, পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা, আওয়ামী লীগের সভায় বোমা হামলা, যুদ্ধাপরাধ, ধর্ষণ, লুটপাট ও গণহত্যাসহ নানা অপরাধে জড়িত ব্যক্তির নাম রয়েছে। এই ৬৪ ব্যক্তির মধ্যে বর্তমানে ইন্টারপোলের রেড নোটিশে ঝুলছে ৬২ জনের নামে।

ইন্টারপোলের ওয়েবসাইট খুঁজে দেখা গেছে, রেড নোটিশে নাম থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় সবার নাম থাকলেও অনেকের ছবি নেই। কে কোন জেলার ঠিকানায় তার উল্লেখ নেই। এমনকি কারো কারো পুরো নামও নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম বলেন, মূলত তদন্তকারী সংস্থাগুলো যেভাবে তথ্য দেয় সেই তথ্যগুলোই ইন্টারপোলে পাঠানো হয়। যেসব ক্ষেত্রে তথ্যের ঘাটতি আছে, সেসব ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তা হয়তো ছবি কিংবা সঠিক তথ্য সরবরাহ করতে পারেননি। রেড নোটিশে নাম থাকায় সর্বশেষ ২০২১ সালে ইতালির পুলিশ কিশোরগঞ্জের জাফর ইকবালকে (৩৮) গ্রেপ্তার করে। তিনি লিবিয়ার মিজদাহ শহরে মানব পাচারকারীদের গুলিতে ২৬ বাংলাদেশিসহ ৩০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলার আসামি।

ইন্টারপোলের তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নূর চৌধুরী, শরীফুল হক ডালিম, খন্দকার আবদুর রশিদ, এমএ রাশেদ চৌধুরী ও খান মোসলে উদ্দিন ওরফে খান মোসলেম উদ্দিনকে দেশে ফেরাতে তৎপর রয়েছে। তাদের মধ্যে নূর চৌধুরী কানাডায় ও রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন। অন্যদের অবস্থানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই।

বেনজীরের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’ জারি

বহুল আলোচিত ও সমালোচিত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারি করেছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল)। গত ১০ এপ্রিল এই রেড নোটিশ জারি করা হয়।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ থেকে পালানো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ আরও ১১ জনের বিষয়টি ইন্টারপোলের আইনি পর্যালোচনাধীন। বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ছাড়াও পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির বিষয়টি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, আদালতের নির্দেশনায় প্রসিকিউশন (রাষ্ট্রপক্ষ) অথবা তদন্ত সংস্থার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) শাখা ইন্টারপোলে রেড নোটিশ জারির আবেদন করে থাকে। পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি পদ মর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকার একটি আদালত সাবেক আইজিপি বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির জন্য ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয়। এরপর গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করতে ইন্টারপোলের কাছে আবেদন করা হয়।

বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতি বা অপরাধের অভিযোগের কারণে দ্রুত পদক্ষেপ হিসেবে গত ১০ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল।

বেনজীরের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, বেনজীর সপরিবারে পলাতক। কোন দেশে আছেন তা এখনো আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি। তবে রেড নোটিশ যেহেতু জারি হয়েছে, আশা করি খুব শিগগিরই তার অবস্থান ও গ্রেপ্তর করে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, বেনজীরের বিরুদ্ধে রেড নোটিশটি এখনও ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়নি। তার অবস্থান শনাক্ত করার পর সেটি ওয়েবসাইটে দেয়া হবে। তবে রেড নোটিশ জারির বিষয়টি বাংলাদেশ পুলিশকে ই-মেইলের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে ইন্টারপোলের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরও ১১ জনের বিরুদ্ধে তিন দফায় ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। চিঠিপত্র আদান-প্রদান ছাড়াও একটি ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধেও রেড নোটিশ জারির বিষয়টি পর্যালোচনা করছে ইন্টারপোল।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদত্যাগ ও দেশ থেকে পালানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ‘রেড নোটিশ’ জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে পৃথক তিন ধাপে আবেদন করেছে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)।