‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর
লাল ফাইলে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর, ভয়ংকর যুদ্ধের প্রস্তুতি ভারতের
পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটির মধ্যে পূর্ণ মাত্রার সংঘাতের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে— বলছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা
কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান-ভারতের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনা দেশ দুটির মধ্যে পূর্ণ সংঘাতের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। গতকাল কাশ্মীর সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গুলি বিনিময়ের ঘটনাও ঘটেছে। এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ।
অন্যদিকে ভারতও ভয়ংকর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে। ইতোমধ্যে সামরিক তৎপরতা জোরদার করেছে দেশটি। তবে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ দুটির মধ্যে পূর্ণমাত্রার সংঘাতের সম্ভাবনা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে গোটা বিশ্বকে— বলছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, জন্মের পর থেকেই সাপে-নেউলে সম্পর্ক ভারত-পাকিস্তানের। প্রতিবেশী হয়েও যেন বহু দূরত্ব তাদের। স্বাধীনতার সাড়ে সাত দশক পেরিয়ে গেলেও দুই দেশের সেই চিরবৈরী মনোভাব কাটেনি বিন্দুমাত্র। দোষারোপের রাজনীতি আর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব থেকে যেন বের হতেই পারছেন না দেশ দুটির রাজনীতিকরাও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত ২৫ বছরে যুদ্ধে জড়ায়নি, তবে তাদের মধ্যে যে খুব শান্তি বিরাজমান ছিল তাও বলা যায় না। লাইন অব কন্ট্রোল সবসময় তাদের কন্ট্রোলে থাকে না, উত্তেজনা লেগেই থাকে। তবে এবারের পরিস্থিতি একটু ঘোলাটে এবং বেশ উত্তপ্ত। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেন আধা-জল খেয়ে লেগেছেন মোদি। শেষমেশ পরিস্থিতি যুদ্ধ পর্যন্ত গড়ায় কিনা এ নিয়ে শঙ্কিত আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
আন্তর্জাতিক মহলে এমন শঙ্কার মধ্যেই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ বলেছেন, ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনা ‘সর্বাত্মক যুদ্ধে’ রূপ নিতে পারে। ভারত সরকার এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করেছে। যদিও এই দাবি ইসলামাবাদ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছে এবং এটিকে ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন হিসেবেও অভিহিত করেছে।
খাজা আসিফ জোর দিয়ে বলেন, ক্রমবর্ধমান কূটনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যে কোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত। ভারত যা কিছু শুরু করবে তার প্রতি আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়া দেখাবো। যদি কোনো সর্বাত্মক আক্রমণ বা এই জাতীয় কিছু হয়, তাহলে অবশ্যই একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ হবে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন, যে পরিস্থিতি এখনো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেতে পারে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত কিনা জানতে চাইলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতিবাচক উত্তর দেন। বলেন, দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে সংঘর্ষ সর্বদা উদ্বেগজনক। যদি পরিস্থিতি সেই রকম কিছু হয়, তাহলে দুঃখজনক পরিণতি আসতে পারে।
এদিকে গতকাল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এবিপি আনন্দের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কাশ্মীরে হামলার পর ভারত যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এর আগে ভারতের পেহেলগামে হামলার ঘটনার পর পাকিস্তান ঘোষণা দেয়, তারা ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালাবে। এ নিয়ে করাচি উপকূলের কাছে নিজেদের ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে’ পরীক্ষার বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তানি নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ২৪-২৬ এপ্রিলের মধ্যে এই মিসাইল পরীক্ষা সম্পন্ন হবে। ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই জানিয়েছে, পাকিস্তানের এ পদক্ষেপ ঘিরে ভারতের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এদিকে পাল্টা প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ভারতও সামরিক তৎপরতা জোরদার করেছে।
বৃহস্পতিবার মিসাইল ধ্বংসের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনী। নিজেদের প্রযুক্তিতে তৈরি আইএনএস সুরাত থেকে এক নিম্ন-উড্ডয়ন মিসাইল সফলভাবে ধ্বংস করা হয়। এক্সে দেয়া এক পোস্টে ভারতীয় নৌবাহিনী বলেছে, এতে তাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। সামপ্রতিক উত্তেজনায় দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ইতোমধ্যে হিমশীতল হয়ে পড়েছে। একে অপরের কূটনীতিক বহিষ্কার করেছে দুই দেশ। বন্ধ হয়েছে আকাশসীমাও। এখন সামরিক শক্তি প্রদর্শনের পালা শুরু হয়েছে সমুদ্র ও আকাশপথে। উভয় দেশই উভয়ের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে ভারতের পক্ষ থেকে সিন্ধু নদের পানি চুক্তি বাতিল অন্যতম।
জবাবে পাকিস্তান পূর্ণ শক্তি দিয়ে এর জবাব দেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এদিকে হামলার পর বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। এ সময় তারা রাষ্ট্রপতির কাছে দুটি লাল ফাইল জমা দেন। এ ফাইল ঘিরে শুরু হয়েছে নানা জল্পনা কল্পনা। কেউ কেউ বলছেন, এই ফাইল দুটি কি যুদ্ধের অনুমতি ও ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত? আর যদি যুদ্ধের অনুমতি চাওয়ার ফাইলই হয় তবে কি নির্দেশনা দিয়েছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি? তিনি কি সত্যিই যুদ্ধের অনুমতি দিয়েছেন?
পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে প্রাণঘাতী হামলার পর পাকিস্তান ও ভারতকে “সর্বোচ্চ সংযম” দেখাতে বলেছে জাতিসংঘ। মূলত হামলার পর দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কূটনৈতিক পদক্ষেপের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এএফপি। হামলার ঘটনাটি ঘটেছে ভারত-শাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে- যা গ্রীষ্মকালে হাজার হাজার পর্যটকের আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র। বন্দুকধারীদের গুলিতে সেখানে কমপক্ষে ২৬ জন নিহত হন, যাদের প্রায় সবাই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বাসিন্দা এবং একজন নেপালের নাগরিক। আহত হন আরও অন্তত ১৭ জন।
এ ঘটনায় পাকিস্তানের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছে ভারত। তবে ভারতের দাবি প্রত্যাখ্যান করে কাশ্মীরের এই হামলাকে সাজানো ঘটনা বলে দাবি করেছে পাকিস্তান। দেশটি বলেছে, এটি ছিল একটি ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন-অর্থাৎ নিজেরাই ঘটিয়ে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা। হামলার এ ঘটনার পর উভয় দেশই উভয়ের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছে এবং এতে করে উভয় দেশের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টেফান ডুজারিক বলেন, ‘মহাসচিব এই পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং এতে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন। আমরা ভারত ও পাকিস্তান- উভয় দেশের সরকারকে সংযম বজায় রাখার জন্য জোরালোভাবে আহ্বান জানাচ্ছি, যেন পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে না যায়।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, মহাসচিব এখন পর্যন্ত পাকিস্তান বা ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করেননি। ডুজারিক আরও বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার যেকোনো সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে এবং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া উচিত।’ ভারতের একতরফাভাবে ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদের পানিবণ্টন চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা প্রসঙ্গে জাতিসংঘ মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা এমন কোনো পদক্ষেপ সমর্থন করি না যা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করতে পারে। তাই আমরা সংযম বজায় রাখার আহ্বানই পুনর্ব্যক্ত করছি।’
তবে জাতিসংঘের এই আহ্বানের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই লাইন অব কন্ট্রোল (এলওসি)-এ ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যেগুলো বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। আজাদ কাশ্মীর সরকারের কর্মকর্তা সৈয়দ আশফাক গিলানি এএফপিকে বলেন, ‘সীমান্তে সেনারাগুলো বিনিময় করেছে। তবে বেসামরিক জনগণের ওপর কোনো হামলা হয়নি।’
এই প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার এক ব্রিফিংয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস জানান, ‘দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, আমরা তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। কাশ্মীর বা জম্মুর অবস্থান নিয়ে আমরা বর্তমানে কোনো অবস্থান নিচ্ছি না।’ এদিকে পেহেলগাম হামলার পর ভারতের কড়া পদক্ষেপের জবাবে পাকিস্তানও পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য স্থগিত, আকাশপথ বন্ধ এবং আরও বেশ কয়েকটি কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষামূলক সিদ্ধান্ত। ভারতের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি একতরফাভাবে স্থগিত করা। বিশ্ব ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং দুই দেশের মধ্যকার নানা বৈরিতার মধ্যেও এতদিন চুক্তিটি টিকে ছিল।