Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ০৯ নভেম্বর, ২০২৪,

ভারতের এক তরফা নদী নিয়ন্ত্রণই বন্যার কারণ: বাপা

মো. মাসুম বিল্লাহ

জুন ২১, ২০২২, ০৪:১৩ পিএম


ভারতের এক তরফা নদী নিয়ন্ত্রণই বন্যার কারণ: বাপা

জলবায়ুর বৈশ্বিক পরিবর্তনে অতি বৃষ্টি, উজানের আন্তঃদেশীয় নদীগুলো ভারত কর্তৃক এক তরফা নিয়ন্ত্রণ এবং অবব্যস্থাপনার কারণেই দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণেই ঘন ঘন বন্যা হচ্ছে বলে মনে করছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)। 

মঙ্গলবার (২১ জুন) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাপার আয়োজনে ‘আকস্মিক বন্যায় সিলেটে মানবিক বিপর্যয়: কারণ ও করণীয়’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। 

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেনের বৈশ্বিক সমন্বয়ক, বাপার কেন্দ্রীয় সদস্য ও যুক্তরাষ্ট্রের লক হ্যাভের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান। 

অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বিগত তিন মাসে সিলেট এবং সুনামগঞ্জসহ হাওরের বিভিন্ন অঞ্চল তিনবার আকস্মিক বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে শুরু হওয়া বন্যায় সিলেট ও সুনামগঞ্জের জেলা শহরসহ প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। হাওরের উজানে অবস্থিত ভারতের মেঘালয় এবং আসামে গত দশ দিনে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতের খবর পাওয়া গেছে। শুধু জুন মাসেই মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ৪০৮১ মিঃমিঃ বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময়কালে সুনামগঞ্জেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে। যেহেতু বিরামহীনভাবে এই বৃষ্টিপাতের ঘটনা ঘটেছে, তাই মেঘনা অববাহিকা অঞ্চলের মাটি পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে থাকার কারণে সমস্ত বৃষ্টির পানি ভূউপরিস্থ প্রবাহে রূপান্তরিত হয়ে নদী-নালা-খাল-বিল প্লাবিত করে বন্যার সৃষ্টি করেছে। এবছরের আগেও ২০১৭, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালেও হাওরের বিভিন্ন অংশে বলা হয়েছিল। উপরোক্ত তথ্য থেকে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়েছে যে অধুনাকালে বন্যার মাত্রা, তীব্রতা এবং স্থায়িত্বকাল বেড়ে গিয়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি স্পষ্টতই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাক্কালনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

বৈশ্বিক, আন্তঃদেশীয়, এবং আভ্যন্তরীণ কয়েকটি কারণকে দায়ী করে বক্তারা বলেন, বৈশ্বিক কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাদের অঞ্চলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং বন্যার মাত্রা যে বেড়ে যাবে তা বিজ্ঞানীরা আগেই প্রাক্কলন করেছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্র-পৃষ্ঠ ক্রমেই উপরে উঠে আসছে, যার ফলে সমুদ্রগামী নদীর প্রবাহ ধীরগতি সম্পন্ন হয়ে পড়ছে এবং নদীগুলি আগের মত কার্যকরভাবে পানি নিষ্কাসন করতে পারছে না। নদীর ধীর গতির কারণে হাওর অঞ্চলে বন্যা প্রলম্বিত হচ্ছে।

আন্তঃদেশীয় কারণ হিসাবে তারা বলেন, উজানের দেশ ভারত কর্তৃক একতরফাভাবে মেঘনা অববাহিকার প্রত্যেকটি নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, বনাঞ্চল উজাড় করা এবং কয়লা ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ উত্তোলনের মাধ্যমে প্রচুর পলি এবং রাসায়নিক দূষণ সৃষ্টি করার কথা উল্লেখযোগ্য। 

মেঘনা অববাহিকার ৫৭ শতাংশ এলাকাই ভারতে অবস্থিত। মেঘনা অববাহিকায় ১৬টি আন্তঃদেশীয় নদী প্রবাহমান, কিন্তু এর একটির জন্যেও পানি পান ব্যবস্থাপনা যৌথভাবে করার জন্য কোনো চুক্তি নেই। যৌথ নদী কমিশনের তালিকাবদ্ধ এই ১৬ আন্তঃনদীর বাইরেও আরও ৩০টির মত ছোট ছোট আন্তঃদেশীয় নদী-নালা এবং খাল রয়েছে। শুকনা মৌসুমে ভারত সেচ ও পানিবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য নদীর পানি ধরে রেখে ইচ্ছানুযায়ী ছাড়ে।

অন্যদিকে, বর্ষাকালে উজানের সমস্ত বাঁধ এবং জলাধারের গেইট খুলে দিয়ে ভাটিতে অবস্থিত হাওর অঞ্চলে বন্যার তীব্রতা বাড়াতে সহায়তা করে।

বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেঘনা অববাহিকার ৪৩ শতাংশ এলাকায় অবস্থিত, কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিগত সাত দশক ধরে বেষ্টনী বা কর্ডন-ভিত্তিক ভুল পানি নীতিমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের নদী, জলাশয় এবং হাওরের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। নদীর পাড় ধরে বাঁধ, পোল্ডার এবং বিভিন্ন ধরনের ভৌত অবকাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। হাওরের সমস্ত ভূউপরিস্থ প্রবাহই ভৈরব বাজারে অবস্থিত মেঘনা নদীর উপরে নির্মিত তিনটি রেলওয়ে ও সড়ক সেতুর নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই ব্রীজগুলির কারণে নদীর প্রস্থচ্ছেদ অনেক খানি কমে গিয়েছে। ব্রীজগুলির উজানে মেঘনা নদীর প্রস্থচ্ছেদ অনেক বেশি। উজানের পানি প্রবাহ ব্রীজের নীচে এসে বাধাগ্রস্থ হয়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে বলে প্রতীয়মান হয়।

উপরোক্ত অব্যবস্থাপনার কারণে বন্যার নিয়ন্ত্রণ কিংবা প্রশমন না হয়ে বরং বন্যারজনিত ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বালু উত্তোলন, প্লাবনভূমি দখলের মাধ্যমে নন-নদীর প্রবাহ ধারন ক্ষমতা কমিয়ে আনা হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে বন্যার প্রকৌপ বেড়েই চলেছে।
 
পরিত্রাণের উপায়:

বন্যার পরিত্রাণের উপায় প্রসঙ্গে বাপা নেতৃবৃন্দরা বলেন, প্রথমত, নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে হবে। বাংলাদেশের কৃষ্টি, শিল্প, সাহিত্য, সভ্যতা এবং ব-দ্বীপ গঠনে নদীর ভূমিকা হৃদঙ্গম কার নদী ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, নদীর প্রাকৃতিক কার্যপ্রক্রিয়া আমলে নিয়ে নদীর প্লাবনভূমি নদীর প্রবাহের জন্য বরাদ্দ রেখে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের নামে নদীর ধ্বংস প্রক্রিয়া রহিত করে, জলবায়ু প্রবর্তনহেতু সৃষ্ট বাড়তি প্রবাহ ধারণের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নদী বক্ষ থেকে বাড়তি পলি ক্রমান্বয়ে ড্রেজিং এর মাধ্যমে সরাতে হবে। 

তৃতীয়ত, নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। 

চতুর্থত, প্রত্যেকটি নদীর উৎস থেকে মুখ পর্যন্ত অববাহিকা ভিত্তিক সমন্বিত পানি-পলি ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে সমস্ত অংশীজনের স্বার্থরক্ষাকারী দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। 

পঞ্চমত, জাতিসংঘের পানি প্রবাহ আইন কার্যকর করে, সেই আইনের আলোকে চুক্তি করতে হবে এবং গ্যারান্টি ক্লজসহ সেই চুক্তির বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। 

ষষ্ঠত, সমস্ত আন্তঃদেশীয় নদীর পানি-পলি অবস্থাপনাকে রাষ্ট্রীয় কূটনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে হবে। নদী বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে এই সত্যটি সবার হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং সেই মোতাবেক সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে।

বাপার সহসভাপতি ও বেনের প্রতিষ্ঠাতা ড. নজরুল ইসলাম সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিলের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য দেন— বাপার নির্বাহী সহসভাপতি ডা. মো. আব্দুল মতিন, যুগ্ম সম্পাদক শারমীন মুরশিদ ও অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার, নদী ও জলাশয় বিষয়ক কমিটির সদস্য ড. হালিম দাদ খান, সিলেটের সারি নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদী প্রমুখ।


ইএফ

Link copied!