Amar Sangbad
ঢাকা সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪,

কী কারণে জনপ্রশাসনে অসন্তোষ?

আমার সংবাদ ডেস্ক

আমার সংবাদ ডেস্ক

ডিসেম্বর ২২, ২০২৪, ১০:৪০ পিএম


কী কারণে জনপ্রশাসনে অসন্তোষ?

জনপ্রশাসনে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্যান্য ক্যাডারের জন্য বাকি ৫০ শতাংশ কোটা রাখার বিষয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে; তার প্রতিবাদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বড় জমায়েত নিয়ে সচিবালয়ে গিয়েছিলেন আজ।

পদোন্নতিতে কোটা কমানো হতে পারে এমন শঙ্কার জায়গা থেকে ক্ষোভ বাড়ছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য বিদ্যমান কোটা বহাল রাখার দাবিতে সংস্কার কমিশনের সদস্যসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজেদের দাবির কথা জানিয়েছেন তারা।

অন্যদিকে, পাল্টা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ‍‍`আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ‍‍`।

উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করতে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের প্রতিবাদে রোববার সচিবালয়ে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন কর্মকর্তারা। একই সাথে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারকে আলাদা করে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস প্রতিষ্ঠার দাবিতেও সরব হয়েছেন এই কর্মকর্তারা।

এই দাবি নিয়ে রোববার সচিবালয়ে জনপ্রশাসন সচিব ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যসচিব মো. মোখলেস উর রহমানের সাথে বৈঠক করেন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বা বিএএসএ।

বিএএসএ সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ের ভিত্তিতে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ ও অন্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ নেওয়া হয়। এটি একটি মীমাংসিত বিষয়। এ বিষয়ে নতুন করে ভিন্ন সুপারিশ প্রস্তাবের বিষয়টি আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন যদি তাদের এই দাবি মেনে না নেয় তাহলে নতুন করে কর্মসূচি দেওয়ার কথাও ভাবছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক শেষে রোববার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এখানে কয়েকটা মৌলিক বিষয় নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি বা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। চূড়ান্তভাবে সুপারিশ দেওয়ার আগে আমরা প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে বসে একটা সিদ্ধান্ত নেব।

তবে, প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে বাকি ২৫টি ক্যাডার ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‍‍`আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ‍‍` পাল্টা দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

প্রশাসন ক্যাডারদের ক্ষোভের কারণ

গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্যসচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান।

এসময় কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশের কিছু বিষয় তুলে ধরেন তারা। সেখানে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেছিলেন, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের ৫০ শতাংশ এবং অন্য সব ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কোটা রাখার সুপারিশ করা হবে। ডেপুটি সেক্রেটারি লেভেলে পরীক্ষা হবে, সেখানে সবাই পরীক্ষা দিতে পারবে।
একইসঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে যেখানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য ৭৫ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারের জন্য ২৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়, তা বদলে এই অনুপাত প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ক্যাডারদের জন্য ৫০ শতাংশ করা হবে বলেও জানান তিনি।

একই সভায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডারে না রেখে আলাদা কমিশন করার কথা জানান সংস্কার কমিশনের সদস্যসচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমান। তবে সংস্কার কমিশন প্রধান ও সদস্যসচিবের এসব বক্তব্য ইতিবাচকভাবে নেননি ক্যাডারদের কোনো পক্ষই।

গণমাধ্যমে এসব খবর আসার পর থেকেই সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া জানায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। এরপরই বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে কমিশন প্রধানের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। একই ঘটনা দেখা যায় বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস হেলথ ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতিতেও।

কোনো রকম আলোচনা ছাড়া এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায় ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‍‍`আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ‍‍`।

জনপ্রশাসন কর্মকর্তাদের অবস্থান

রোববার (২২ ডিসেম্বর) সকাল ১১টার দিক থেকেই সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে জড়ো হতে থাকেন প্রশাসন ক্যাডারের কয়েকশ’ কর্মকর্তা।

সচিবালয়ের বাইরে যারা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে কর্মরত, তাদের অনেকেই যোগ দেন সচিবালয়ের এই কর্মসূচিতে। ঢাকার বাইরে থেকেও কেউ কেউ এসেছিলেন সচিবালয়ে।

ফেনীর একটি উপজেলা থেকে আসা প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, সংস্কার কমিশন এখন যে প্রস্তাব করছে তাতে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অন্য ২৬টি ক্যাডারের কারোরই পরীক্ষা দিতে হবে না। উল্টো নিজ ক্যাডারে প্রমোশনের জন্য আমাদের পরীক্ষাও দিতে হবে আবার সেখানে কোটাও থাকবে। এটা কেমন বৈষম্য নিরসন হলো?

রোববার বেলা পৌনে ১২টার দিকে প্রশাসন ক্যাডারের কয়েকশ কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সামনে অবস্থান নেন। তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমানের সঙ্গে দেখা করে তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন।

বেলা ১২টার দিকে ওই কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় তলায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের দপ্তরের সামনে অবস্থান নেন। সেখান থেকে বের হয়ে হয়ে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়গুলো নিয়ে জনপ্রশাসন কমিশনকে জানিয়েছি। আমাদের সাথে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে বসার জন্য বলেছি। এখন তাদের সাথে বসে আলোচনা হতে পারে।

এসময় তারা সংগঠনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাবি ও এর পক্ষে তাদের যুক্তি এবং এই বিষয় নিয়ে উচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়গুলোও তুলে ধরেন জনপ্রশাসন সচিবের কাছে।

চট্টগ্রামের বিভাগের একটি জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একদিকে বলা হচ্ছে মেধার মূল্যায়ন করতে হবে। অপরদিকে মেধার পরিবর্তে কোটাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। অধিক নম্বরপ্রাপ্ত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণকে তাদের পদোন্নতিযোগ্য পদ হতে আরও একবার বঞ্চিত করে তুলবে যদি সংস্কার কমিশনের এই প্রস্তাব পাশ করা হয়।

এরই মধ্যে সারাদেশের ৬৪ জেলায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে একটি নেটওয়ার্ক করে নিজেদের এই দাবিগুলোর ব্যাপারে সরব হচ্ছে। সেখানে বৈষম্য নিরসনের পাশাপাশি যুগোপযোগী সিভিল প্রশাসন হিসেবে ‍‍`বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস‍‍` প্রতিষ্ঠার দাবি জানানো হয়।

প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা এ দাবিতে আলাদা লোগো তৈরি করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করছেন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, প্রত্যেকটি জেলা পর্যায় থেকে আলাদা আলাদাভাবে এই দাবি উঠেছে। আমরা এই দাবি নিয়ে কথা বলার পর জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে সময় দিয়েছি। জনপ্রশাসন সচিব আশ্বাস দিয়েছেন যে শিগগিরই এ নিয়ে বসবে সংস্কার কমিশন।

তিনি আরও বলেন, আমরা আপাতত তিন-চারদিন কোনো কর্মসূচির পথে যাচ্ছি না। এর মধ্যে যদি সমাধান না হয়, তাহলে পরবর্তীতে কি কর্মসূচি হতে পারে সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিব।

পাল্টা আন্দোলনে অন্যরাও

প্রশাসন ক্যাডার বাদে বাকি ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত হয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। গত মঙ্গলবার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন প্রধানের বক্তব্যের পর বৃহস্পতিবার সংগঠনটি থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলাপ না করেই ডিএস পুলে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ ও অন্য ২৫টি ক্যাডারের জন্য ৫০ শতাংশ নিয়োগ এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারকে সিভিল সার্ভিস থেকে আলাদা করার প্রতিবাদ জানানো হয়।

পরদিন এ নিয়ে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক ড. মুহম্মদ মফিজুর রহমান বলেছিলেন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আটজনের মধ্যে ছয়জনই প্রশাসন ক্যাডার থেকে। বাকি ২৫টি ক্যাডারের কোনো প্রতিনিধিই সেখানে নেই। ফলে নীতিনির্ধারনের ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারই গুরুত্ব পেয়েছে।

শনিবার নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ। সেখানে তারা কিছু কর্মসূচি নিয়েছে যেমন- সোমবার প্রতিটি ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশন এ বিষয়ে বিবৃতি দেবে। পরদিন মঙ্গলবার কলমবিরতি এবং ২৬শে ডিসেম্বর সব অফিসের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি। এই দাবির পক্ষে আগামী ৪ জানুয়ারি ঢাকায় সমাবেশ কর্মসূচির কথাও জানিয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ।

তবে অন্য ক্যাডার সার্ভিসের এই কর্মসূচি ঘিরে কিছুটা উত্তেজনাও তৈরি হয়েছে প্রশাসনিক খাতে। বিএএসএ সভাপতি মো. আনোয়ার উল্ল্যাহ বলেন, হঠাৎই অন্য ক্যাডার সার্ভিসগুলো যে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে এটিকে আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এর পেছনে কারণ কী সেটাও আমরা জানতে চাই।

যদিও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এই মুহূর্তে তারা যে খসড়া করেছে সেটা কিছু মতামতের ভিত্তিতে করা হয়েছে। তবে এটি চূড়ান্ত কিছু নয়।

রোববার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সদস্য সচিব ও জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমান বলেছেন, সংস্কার কমিশনের সুপারিশ এখনো কোনো আকার নেয়নি। কোনো আকার নেওয়ার আগে আমরা সব পক্ষের সাথে বসে আলাপ করে একটা সিদ্ধান্ত নেব।

আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যেই সরকারের কাছে তাদের সুপারিশ জমা দেওয়ার কথা বলছে কমিশন।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

ইএইচ

Link copied!